মুর্শিদাবাদ মানেই বাংলা ইতিহাসের আড়তঘর। অলিগলি জুড়ে নবাবী আমলের হাজার উপাখ্যানরা জমায়েত। নিছক এক ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেই আজ তাই এর পরিচিতি। কিন্তু ওই হাজারদুয়ারী, ইমামবরা, কাটরা মসজিদের শিল্প, চিত্রকলার আড়ালে মুর্শিদাবাদের যে আরও একটি পরিচয় রয়েছ তা জেনে আপনার চোখ ছানাবড়া হবেই। আর শুধু চোখ কেন হয়ত মুখেও ছানাবড়ার লোভনীয় স্বাদটি অনুভব করতে পারেন। মুর্শিদাবাদের যেকোনো মিষ্টির দোকানে একবার ঢুঁ মেরে দেখুন ছানাবড়া মিষ্টিটিকে বেশ নবাবী মেজাজেই বসে থাকতে দেখবেন। সেই ঢাল তলোয়ারের আমল থেকেই এর যেন এক আলাদা জৌলুস। আর জনপ্রিয়তাও নেহাৎ কম নয়। আজ তাই মুর্শিদাবাদের ওই হিংসা ষড়যন্ত্র যুদ্ধের মতো নিরস ইতিহাসগুলো ছেড়ে চলুন সুস্বাদু রসালো এই ছানবড়া মিষ্টির ইতিহাসটি জানা যাক।
ছানাকে ঘি ও ময়দা দিয়ে ভেজে তাকে গাঢ় মিষ্টি রসে ডোবালেই তৈরী হয় অপূর্ব স্বাদের ছানাবড়া। আর ছানাকে এভাবে গোল করে ঘি তে ভাজার জন্যই এর নামও রাখা হয় ছানাবড়া। ছানাবড়ার উৎপত্তি নিয়ে বিশেষ কিছু না জানা গেলেও মতভেদ তো রয়েছেই। শোনা যায় প্রায় ২০০ বছর আগে কাশিমবাজারের রাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ব্রিটিশদের খুশি করতে অভিনব ও সম্পূর্ণ নতুন এক মিষ্টি তৈরীর জন্য রাজ্যের ময়রাদের নির্দেশ দেন। আর তারপরই ময়রা পটল সাহার হাত ধরে ছানাবড়ার আবির্ভাব ঘটে মুর্শিদাবাদের মাটিতে। আবার কেউ বলেন থাকেন ২০০ বছর আগে লালবাগের আদি মিষ্টি দোকানের মালিক নিমাই মন্ডল এই মিষ্টির আবিষ্কর্তা। মিষ্টির উদ্ভব নিয়ে এমন দোমনা থাকলেও নিমাই মন্ডলের ছানাবড়া যে নিজামত পরিবারের নবাবী থালায় জায়গা করে নিয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
শুধু স্বাদের গুণে নয় ছানাবড়ার আকৃতি এতটাই বড় যে চোখ আটকে যাওয়ার জোগাড়। তাই তো “চক্ষু ছানাবড়া” কথাটি লোকমুখে এত প্রচার পেয়েছে। নবাবী ভোজনালয়ে রূপোলী থালায় এক কি দেড় মন ওজনের এই মিষ্টিটির পরিবেশন ছিল আলাদাই এক গাম্ভীর্য। শুধুই নবাবরা নাকি! ১৯৩৮ সালে বহরমপুরের ছানাবড়া পেয়ে নেতাজী এতই আনন্দিত হয়েছিলেন বলার নয়। আবার ১৮৯৮ তে এই বহরমপুর থেকে আনা প্রায় ৫৫ কেজি ওজনের ছানাবড়া দেখে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দও হতভম্ব হয়ে পড়েন। ৫কেজি থেকে ৩০ কেজি সব ওজনেরই ছানাবড়া প্রস্তুত করা হয়। ৫-১০ টাকার ছোট ছানাবড়াও পাওয়া যায় এখানে। মিষ্টি বিক্রেতারা মূলত অর্ডার অনুযায়ী ওই দৈত্যাকার ছানাবড়া বানিয়ে থাকেন।
মুর্শিদাবাদের ছানাবড়া যার মুখে একবার পড়েছে নিঃসন্দেহে সে জড়িয়েছে এর স্বাদের মায়ায়। আজ হয়তো দেশের যে কোনো জায়গায় চাইলেই এর স্বাদ আপনি পেয়ে যাবেন কিন্তু মুর্শিদাবাদের তৈরী ছানাবড়ার মতো ওই রসনাতৃপ্তিটি হবে না। স্বাদে গন্ধে আর দর্শনে মুর্শিদাবাদের ছানাবড়া এক ও অদ্বিতীয়। তাই মুর্শিদাবাদের বাজারে রকমারি মিষ্টির আনাগোনা থাকলেও ছানাবড়া রয়েছে আজও তার নবাবী হালেই।
Discussion about this post