ঈষৎ লাল,উপরে ক্ষীরের দানা লম্বাটে গড়ন,ভিতরে ভরাট রসালো ছানা। কোন মিষ্টির নাম মাথায় আসছে? চমচম! খানিক শুকনো আবার রসালোও! ‘রসের আড়ত রসগোল্লার ন্যায় চমচম চিনির রসে ডুবে থাকে না। তবে মিষ্টি কোনো অংশে কম নাকি! সে তার তেজোদীপ্ত ভঙ্গিমায় সন্ধ্যের জলযোগে কিংবা বাঙালি বাড়ির অতিথির প্লেটে একচ্ছত্র অধিপতি। চমচমের আভিজাত্যের কাছে নতি শিকার করবে নামী দামি মিষ্টি। আর এই চমচম হতে হবে বেলাকোবার। ব্যস বাকি সব মিষ্টির স্পিকটি নট!
তবে এই চমচমের সফর শুরু কিন্তু উনবিংশ শতকে ময়মনসিংহ জেলায়। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি এলাকায় সে প্রথম পায় তার রূপ। ক্রমেই দিকেদিকে ছড়িয়ে পড়ল খ্যাতি। ‘চমচমের রাজধানী’ হিসেবে বিপুল নামডাক হল পোড়াবাড়ির। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির টালমাটাল অবস্থা তখন। অবশেষে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল ইংরেজ শাসকদের হাত থেকে। কিন্তু কাঁটাতার পড়ল বাংলার বুকে। অতঃপর টাঙ্গাইলের অনেক ময়রাই চলে এলেন এপার বাংলায়। যেমন,দুই বন্ধু ধীরেন সরকার ও কালিদাস দত্ত। ময়মনসিংহ ছেড়ে জলপাইগুড়ির বেলাকোবা হল তাঁদের নতুন ঠিকানা। সঙ্গে আনলেন চমচমের ম্যাজিক!খানিক নিজস্ব ছোঁয়াও দিলেন তাতে।
শুধু ছানা-ময়দা-চিনি নয় বরং খোয়া ক্ষীর যুক্ত হল নতুন চমচমে। একটু বেশি পরিমাণেই। কিন্তু তাতে স্বাদের মাত্রা বেড়ে গেল ততোধিক। একদম শেষে,উপরে ক্ষীরের আস্তরণ। বাঙালির পাতে হাজির একদম নতুন বেলাকোবার চমচম। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে সময় বেশি লাগেনি। ভারতের বাইরেও সে সমানভাবে দীপ্যমান। সেই প্রবাদপ্রতিম দুই বন্ধুর মিষ্টির দোকান এখনো আছে জলপাইগুড়িতে। বেলাকোবার রেললাইনের দুই পারে অবস্থান তাদের।
এখনো একইভাবে মেনে চলা হয় চমচম প্রস্তুতির সকল নিয়ম। না গরম না ঠান্ডা এমন অবস্থায় মাখতে হয় ছানা। হতে হবে খাঁটি দুধের ছানা। তারপর সারারাত কড়া পাকের রসে চুবিয়ে রাখা হয়। তবেই না সে হবে বেলাকোবার ঐতিহ্যবাহী চমচম! প্রায় সারাবছরই দেশ-বিদেশ থেকে অর্ডার আসতে থাকে দোকানগুলিতে। এখানকার বেশিরভাগ দোকানের বাইরেই লেখা “এখানে বেলাকোবার চমচম পাওয়া যায়।” বোঝাই যাচ্ছে, বাজারে বেলাকোবার চমচমের চাহিদা ঠিক কত?
২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শিকারপুর, বোদাগঞ্জ,গজলডোবাকে কেন্দ্র করে নতুন পর্যটনস্থান গড়ে তুলেছিল। তার মধ্যমণিই ছিল বেলাকোবার চমচম। তবে এখানকার স্থানীয় মিষ্টি প্রস্তুতকারকদের দীর্ঘদিনের আবেদন ,কলকাতার রসগোল্লা, বেলিয়াতোড়ের মেচা সন্দেশের মতো বেলাকোবার চমচমকেও দেওয়া হোক জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ। এবার সময়ই বলবে কতটা কি হয়! কিন্তু তাতে স্বাদ তো আর কমছে না। জলপাইগুড়ি ঘুরতে এলে তাহলে বেলাকোবার চমচম খাওয়ার তালিকায় পয়লা নম্বরে যেন থাকে!
Discussion about this post