বীরভূমের ঝাড়খণ্ড সীমানায় তাঁত শিল্পের জন্য বিখ্যাত তাঁতিপাড়া গ্রাম। গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দাদের মূল জীবিকা এটিই। এখানকার হাতে বোনা কাপড়ের চাহিদা দেশে এবং বিদেশেও। কিন্তু পাশাপাশি আরও একটি জিনিস রয়েছে, যাকে বছরের পর বছর ধরেই মানুষ এককথায় চেনেন। এখনকার জিলিপি। এই জিলিপি তৈরির ঘরানা ৩০০ বছরের পুরনো। বীরভূম জেলার রাজনগর ব্লকের তাঁতিপাড়া গ্রামের জিলিপির চাহিদা কয়েক শতকের পরেও ফুরোয়নি।
বীরভূমের এই বিশেষ জিলিপির সৃষ্টি হয়েছিল তাঁতিপাড়ার দে পরিবারের হাত ধরে। জিলিপি বানানোর জন্য তাঁরা মুর্শিদাবাদ থেকে খাঁদুয়া কলাই ডাল আনাতেন৷ সেই ডাল রোদে শুকিয়ে, জলে ভিজিয়ে খোসা তোলা হত৷ যে ডালে খোসা লেগে থাকত, সেগুলি সোজা বাদ দেওয়া হত, কারণ স্বাদ হতে হবে নিখুঁত। পরে সেই ডাল বেঁটে, ফেটিয়ে, ঢেঁকি ছাটা আতপ চালের গুঁড়োর সঙ্গে মেশানো হত৷ ময়রারা এর নির্যাসকে গরম ঘিয়ে ভেজে ঠান্ডা রসে ফেললেই তৈরি রসালো জিলিপি। এখনও সকাল ৭ টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত জিলিপি ভাজা চলে। দোকানের সামনে থাকে আট থেকে আশির ভিড়।
তাঁতিপাড়ার এই জিলিপি তৈরির বৈশিষ্ট্য হল, এতে কোনো ঝাঁঝরা ব্যবহৃত হয়না। সরাসরি জিলিপি ছেড়ে দেওয়া হয় কড়াইয়ে। সময়ের সঙ্গে নিয়ম এক থাকলেও উপকরণে ঘটেছে বদল। বর্তমানে খাঁদুয়া কলাইয়ের বদলে ব্যবহার হচ্ছে কালো কলাই৷ আর ঘিয়ের বদলে জিলিপি ভাজা হচ্ছে ব্র্যান্ডেড কোম্পানির সাদা তেলে। কিন্তু জিলিপির চাহিদা কমেনি মোটেও। এখনও পুজো, ভাইফোঁটায় স্থানীয় মানুষের থেকে তো বটেই, অর্ডার আসে বিভিন্ন জেলা থেকেও। শ্বাস ফেলার সময় পান না ময়রারা।
সিউড়ির বিখ্যাত পাথরচাপড়ি মেলার জন্য নাকি এই তাঁতিপাড়া থেকে মিষ্টির দোকান ডেকে এনেছিলেন দাতাবাবা। সেই মিষ্টির দোকানটি ছিল এই দে পরিবারের। একশ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পাথরচাপড়ির মেলায় দে পরিবারের মিষ্টির দোকান বসে। পদ্মপুরের বেগুনি, রানীশ্বরের গুটকা বালুসাহী, নারকেল কুল, সরবতি আলুর সঙ্গেই মেলার মূল আকর্ষণ থাকে তাঁতিপাড়ার বিখ্যাত জিলিপি। বর্তমানে পুরনো জিলিপি কারিগররা বেঁচে নেই। তাঁদের উত্তরাধিকারীরা তুমুল উৎসাহে এবং জীবিকার তাগিদে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁতিপাড়ার জিলিপির ঐতিহ্যকে।
Discussion about this post