বাঙালি জাতি চিরকালই শিল্পের অনুরাগী। বাঙালির জীবনযাপনে তার বহিঃপ্রকাশও ঘটে অহরহ। কাজেই তার খাদ্যাভ্যাসে শিল্পের ছোঁয়া থাকবে না, তা কি হয়? পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশের এমনই এক আদি ঐতিহ্যবাহী পদ হল নকশী পিঠা। জানলে অবাক হবেন, এই পিঠার মাধ্যমে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসও কীভাবে হয়ে উঠেছে ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল! জনপ্রিয় এই পদ নিয়ে প্রচলিত আছে বহু লোকগাথাও।
বাংলাভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য এবং ময়মনসিংহের গীতিকার কাজল রেখা আখ্যানের সূত্র ধরে গত আনুমানিক পাঁচশ’ বছর সময়কাল ধরে বাঙালি খাদ্যসংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার উল্লেখ পাওয়া যায়৷ এ প্রসঙ্গে বেশ প্রচলিত রাণী কাঞ্চনমালার আখ্যান। হাতের কাঁকন দিয়ে কেনা দাসী কাঁকনমালার কূটবুদ্ধিতে পরাজিত হয়ে কাঞ্চনমালার জীবনে নাকি নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা৷ অবশেষে এক সুতাওয়ালার সাহায্যে চন্দ্রপুলী, মোহনবাঁশি, ক্ষীর মুরলী পিঠা বানিয়ে কাঞ্চনমালা প্রমাণ করেন যে তিনিই প্রকৃত রাণী! এ হেন চমৎকার পিঠার উৎপত্তির গল্পটা স্বাভাবিকভাবেই একটু অন্যরকম।
যতদূর জানা যায়, নকশি পিঠার উৎসস্থল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী নরসিংদী জেলা। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, নরসিংদী ও গাজীপুর জেলার নারীরা ছিল যেমন সৌখিন, তেমনি ছিল তাদের শিল্পবোধ। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের সময় পূর্ববঙ্গের মেয়েরা ছিলো অবহেলিত। তাই তাদের সুখ দুঃখ, আনন্দ, সৃষ্টিশীলতা – প্রাধান্য পেত না কিছুই। তাদের হাতে না ছিল কাঠপেন্সিল, আর না ছিল রঙিন রং-তুলি যার মাধ্যমে তাদের শৈল্পিক মনোভাব প্রকাশ পেতে পারত। এই নকশী পিঠার কারুকার্য দিয়েই তাদের শিল্পী মনের প্রকাশ ঘটত। তবে কীভাবে প্রথম বানানো হল এই পিঠা? শোনা যায়, নরসিংদীর মেঘনা পাড়ের এক গ্রামে আলপনা আঁকা হত চালের গুঁড়া দিয়ে। তা দেখেই ১৩ বছরের এক বালিকা চালের আটা সেদ্ধ করে সেই সেদ্ধ মন্ড হাত দিয়ে চেপে রুটির মত করে খেজুর গাছের কাঁটা দিয়ে সুন্দর নকশা তৈরী করে। সেই নকশা দেখে তার মা, ঠাকুমাসহ বাড়ীর সকল সদস্যরা অবাক হয়ে যান! রোদে শুকিয়ে রাখার পর গ্রামের সবাই নাকি দেখতে আসেন সেই নকশা। তারপর অনেক গবেষণা করে নকশা রুটিটা ডুবো তেলে ভেজে তুলে আবার নলেন গুড়ের সিরাতে দিয়ে তুলে নেওয়া হয়। ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই নকশা করা এই পিঠা ‘নকশী পিঠা’ নামে বাজারজাত হয়।
পৌষে বাংলাদেশে প্রায় ১৩০ রকম নকশী পিঠার আয়োজন করা হয়। এই নকশী পিঠার নামগুলোও ভারী চমৎকার! তার মধ্যে শাপলা বাহার, গোলাপ বাহার, পাতা বাহার, গেন্দা বাহার, পদ্ম বাহার, কল্কে ফুল বাহার, জবা বাহার ইত্যাদি অন্যতম। আরও রয়েছে ঝিলিমিলি, মালা, জোড়া ময়ূর, পদ্মদীঘি, এলোকেশী, কুলাবাহার, কড়িকোমল, কইন্যাবরণ, কইন্যামুখী, জামাইমুখী, জামাই সুখ, জামাই মুছরা, জামাই ভুলানি, জামাই বরণ, সতীন মুছরা, সজনে ফুল, ঝিঙ্গা ফুল, কদম ফুল, ময়ূর পেখম, মইফুলি, ডালিম দানা, মোরগ ঝুঁটি, ঘর নকশা, জামদানি ইত্যাদি নামের নকশী পিঠা। তবে এই নকশী পিঠা তৈরির জন্য কিন্তু প্রয়োজন সীমাহীন ধৈর্য্য এবং প্রচুর শ্রম। কাঁথা সেলাই বা আলপনা আঁকার মতই, বাঙালি মহিলার স্নেহের স্পর্শ ও কোমলতাই যেন ফুটে ওঠে পিঠার প্রতিটি নকশায় – যা একটি সাধারণ ধানের পিঠেকেও রূপান্তরিত করতে পারে অসাধারণ শিল্পে!
সম্পাদনায় সুমেধা কর মহাপাত্র
Discussion about this post