রথের সঙ্গে বাঙালীদের অনুভূতির পরিচয় আর আলাদা করে নাই বা করালাম!বিকেল হলেই রথ-টানার উত্তেজনা, পাপর আর জিলিপি এই সুস্বাদু জুটির অপেক্ষা প্রায় সব বাঙালীকেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাদের ফেলে আসা শৈশবের দিনগুলোতে। ছোট হোক বা বড়, রথের দিনে বেলঘরিয়ার রথতলার রথের মেলা যাবেনা এমন বাঙালি কিন্তু দূরবীন দিয়ে খুঁজলেও পাবেননা! এই রথের মেলা এতটাই আকর্ষণীয় যে আপনি একবার গেলে বারবার যেতে চাইবেন। তবে এই রথতলার রথযাত্রার পেছনে কিন্তু একটা বিশেষ ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে!
এতটা অবধি পড়েই জানতে ইচ্ছা হচ্ছে তো কী সেই বিশেষ ইতিহাস? তবে আর দেরী না করে ফিরে যাই পুরনো সেই দিনের কথায়,সে প্রায় আজ থেকে দুশো বছর আগের কথা,বাংলা ১২০১ সন। হঠাৎ একদিন বালির পাঠকবাড়ির কর্তা স্বপ্নাদিষ্ট হলেন। তাঁর প্রতি আদেশ হল – বালিঘাটে, গঙ্গায় নিমকাঠ ভেসে আসবে। সেই নিম কাঠ দিয়ে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি তৈরি করে, পাঠাতে হবে বেলঘরিয়ার ঘোষাল পরিবারে। জগন্নাথ সেখানেই রথের পুজো গ্রহণ করবেন এবং উল্টো রথের দিন আবার ফিরে যাবেন বালিতে। একই সময়, স্বপ্নাদেশ পান বেলঘরিয়ার রথযাত্রার প্রতিষ্ঠাতা ‘ঘোষাল পরিবারের’কর্তাও। এই ঘোষালদের সাথেই জড়িয়ে রয়েছে বেলঘরিয়ার রথযাত্রার ইতিহাস।এই পরিবারের প্রধান পিরিতরাম ঘোষাল শুরু করেন পূজার্চনা। ২২৫ বছর আগে শুরু হয় রথতলার এই আকর্ষণীয় রথযাত্রা। তবে সে-আমলে রথ থাকত ঘোষাল পরিবারের তত্ত্বাবধানে এবং বিগ্রহ থাকত বালির পাঠক পরিবারের কাছে।
প্রথমদিকে, এই রথটি ছিল কাঠের এবং খুব উঁচু। একবার এক দুর্ঘটনায় ভেঙে যায় সেই রথ। সবার মাথায় হাত। কারণ, ঘোষাল পরিবারের আর্থিক অবস্থা তখন খানিকটা পড়তির দিকে। নতুন রথ তৈরি করার যে বিপুল খরচ, তা তাঁদের সামর্থ্যের বাইরে। ঠিক তখনই, ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে আসেন এক বৃদ্ধা পরিচারিকা। সারাজীবন ঘোষাল পরিবারেই কাজ করেছেন তিনি। এমন বিপদের দিনে, যে ঘোষালদের সম্মান রক্ষার্থে তিনি বিক্রি করে দেন তাঁর হাতের দুটি সোনার বালা। সেই টাকা দিয়েই তৈরি হয় একটি লোহার রথ। এমনই অনেক ঘটনা জড়িয়ে আছে বেলঘরিয়ার রথের ইতিহাসের সঙ্গে। যার খানিকটা মিথ, কিছুটা আবার ঐতিহাসিকভাবে সত্য। অবশ্য, দুশো বছরেরও বেশি পুরনো এমন উৎসবের সঙ্গে যে কল্পনাও মিশে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।
যখন বালি ব্রিজ তৈরি হয়নি, বালি থেকে বেলঘরিয়ায় বিগ্রহ আনার পথটিও বেশ আকর্ষণীয় ছিল। জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে আসা হত উত্তরপাড়া খেয়াঘাটে, তারপর সেখান থেকে নৌকোয় চেপে আড়িয়াদহ ঘাট। আড়িয়াদহ থেকে আবার ঘোড়ার গাড়ি করে বেলঘরিয়ার ঘোষাল বাড়িতে। রথের আগের দিন বিগ্রহ চলে আসত বেলঘরিয়ায়। আটদিন কাটিয়ে, উল্টোরথের পরের দিন ফেরত পাঠানো হত আবার। পরবর্তী সময়ে, যখন বালি ব্রিজ তৈরি হয়ে যায়, মোটরগাড়িতে করেই বেলঘরিয়ায় নিয়ে আসা হত বিগ্রহ। দুপুরে ঘোষালবাড়িতে ভোগারতির পর, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে ফিডার রোড ও বিটি রোডের সংযোগস্থলে রথতলায় নিয়ে গিয়ে রথে বসানো হত। সেখান থেকে বিটি রোড ধরে মতিলাল শীলের ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত যেত রথ। উল্টোরথের দিন ফিরে আসত আবার যথাস্থানে।
এখন যেখানে ক্ষুদিরাম বসু হাসপাতাল, সে-জায়গাটা ছিল আগে ঘোষালদের মালিকানায়। সারাবছর সেখানেই থাকত রথটি। আস্তে আস্তে লোকমুখে পুরো এলাকাটাই পরিচিত হয় ‘রথতলা’ নামে। একসময় সেখানে শুরু হয় মেলাও। সময়ের নিয়মে প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে অনেকটাই। দীর্ঘদিন হয়ে গেল, বালি থেকে আর আসে না বিগ্রহ। জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা সারাবছর থেকে যান মতিলাল শীলের ঠাকুরবাড়িতেই। রথের দিন তাঁদের বাইরে আনা হয়। এখন কামারহাটি পৌরসভা ও ইয়ং বেঙ্গল ক্লাবই মূলতঃ পরিচালনা করে রথযাত্রা ও রথের মেলাটি। তবে, ঘোষাল পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে প্রায়-নব্বই বছরের বিশ্বরঞ্জন ঘোষালের অধিকার ও সম্মান অটুট। প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্র হিসেবে, ঘোষাল পরিবারের এই প্রতিনিধিই এখনও স্ব-মহিমায় বর্তমান। বর্তমানের এই পরিস্থিতিতে যখন থমকেছে রথের চাকা তখন পুরনো দিনের কথা কি তারও মনে পড়ে না? সাদামাটা বেলঘর গ্রাম থেকে আজকের জমজমাট ‘বেলঘরিয়া’ হয়ে ওঠার দিনগুলি? একমাত্র রথ যাত্রাই বোধহয় উত্তর দিতে পারে সবকিছুর… আর কেউ নয়!
Discussion about this post