বাঙালি আর মিষ্টি, এই দুটিকে কখনই আলাদা করা যায় না। যে কোনো আনন্দ-উৎসবে, খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠানে শেষ পাতে, খিদে পেলে বা খিদে না পেলেও বাঙালির সবসময়ের উদ্ধারকর্তা হল মিষ্টি। বাঙালিরা ছানা ও পনির তৈরি করতে শিখেছিল পর্তুগিজদের থেকে। ভাস্কো-ডা-গামা কালিকট বন্দরে এসেছিলেন ১৪৯৮ সালে, ফিরে গিয়েছিলেন ১৫০৩ সালে। ভারতে ছানা তৈরির কৌশল শেখা তারও অনেক পরে। কিন্তু তাই বলে কি মিষ্টি ছিল না? ছিল দুধ ছাড়া চিনি, গুড় ইত্যাদি দিয়ে বানানো মিষ্টি। তবে, বাংলাদেশের শিবগঞ্জের আদি চমচমটি কিন্তু তৈরি হয়েছিল খাঁটি ছানা দিয়েই। এই চমচমের বয়স দেড়শো বছরেরও বেশি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের আদি চমচম প্রথম বানানো হয় বাংলার নবাবী আমলে। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়, অর্থাৎ অবিভক্ত ভারতের মালদার অংশ ছিল এই শিবগঞ্জ। সে সময় এ অঞ্চলে ছিলেন অসংখ্য মিষ্টি তৈরির কারিগরের বসবাস। দেশ ভাগের পর তাঁরা বেশিরভাগ পশ্চিমবঙ্গের মালদহে চলে এলেও কিছু পরিবার থেকে গিয়েছিলেন শিবগঞ্জে। সেই সময় থেকেই এখনো তাঁদের পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে ধরে রেখেছেন এই পেশা এবং ঐতিহ্য।
১৮৫৮ সালে শিবগঞ্জ বাজারে আদি চমচম তৈরি করেছিলেন শিবগঞ্জের নরেন্দ্র কুমার সরকার। তাঁর মিষ্টির খ্যাতি ছড়িয়ে যায় সোনামসজিদ. কানসাটসহ সমগ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জে। পরবর্তীকালে শিবগঞ্জের মাত্র তিনটি দোকানে পাওয়া যেত আদি চমচম। আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তার কারণে আদি চমচম তৈরির পদ্ধতি ছড়িয়ে পরে আরো কারগরদের মধ্যে। তবে, মূলত প্রথম সেই তিনটি মিষ্টির দোকানকে কেন্দ্র করেই বাকি মিষ্টির দোকানগুলি গড়ে উঠেছে। তাছাড়া, যে কেউ ইচ্ছা করলেই আদি চমচম তৈরি করতে পারবেন না। গরুর খাঁটি দুধের ছানা ছাড়া আদি চমচম তৈরি অসম্ভব কাজ। এই বিশেষ চমচম তৈরির সঙ্গে অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যও জড়িত রয়েছে।
দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে শিবগঞ্জ তার চমচমের অনন্যতা বজায় রেখেছে। দশ-কুড়ি বছর আগেও বাইরের কেউ শিবগঞ্জে এলে চমচমের বাক্স ভর্তি করে নিয়ে যেতেন নিজের জায়গায়। আজও সেই একইভাবে চমচমের টানেই মানুষ শিবগঞ্জে আসেন। বাক্স ভর্তি করে নিয়ে যান চমচম। কড়া পাকে বিশেষ কায়দায় ছানা, মেওয়া ও চিনির সমন্বয়ে তৈরি এই বিশেষ চমচম একবার মুখে পড়লে তার স্বাদ ভোলা অসম্ভব!
Discussion about this post