এই দোকানে ঢুকে একটু গল্প করলেই বেরিয়ে আসবে অবাক করা সমস্ত গল্প। দোকানের কোনো কারিগর হয়ত আপনাকে একটু দূরের চিরপুরাতন বেঞ্চটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলবেন হ্যাঁ, ওই তো, এখানেই বসেছিলেন জর্জ হ্যারিসন বা রবি শঙ্কর! বাইরে সাইনবোর্ড চোখে পড়বে, ‘উৎপাদক ও রপ্তানিকারক: সেতার, সরোদ, হারমোনিয়াম, তানপুরা, এসরাজ। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে, কলকাতার সবচেয়ে পুরনো সঙ্গীত বাদ্যযন্ত্রের দোকান ‘হেমেন এন্ড কো’কে নিয়ে।
কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এক কোণে একটি ছোট্ট বাদ্যযন্ত্রের দোকান। তারা তৈরি করে চলেছে বিশ্বমানের বাদ্যযন্ত্র। সেগুলি পৌঁছে যাচ্ছে সুদূর ব্রিটেনের রকব্যান্ড বিটলস থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তাবড় তাবড় মহারথীদের হাতে। এই ‘হেমেন অ্যান্ড কো’-এর প্রতিষ্ঠাতা হেমেন চন্দ্র সেন। ইনি ছিলেন মাইহারের আলাউদ্দিন খানের শিষ্য। তাঁর প্রতিটি যন্ত্র হেমেনই তৈরি বা মেরামত করতেন। সেই থেকেই শুরু। পরবর্তীকালে পন্ডিত রবিশঙ্কর থেকে শুরু করে ওস্তাদ আলী আকবর খান, পন্ডিত নিখিল ব্যানার্জী থেকে অন্নপূর্ণা দেবী, আমজাদ আলি খান, পন্ডিত ভীমসেন জোশী, ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ পর্যন্ত প্রায় সকল বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হেমেন অ্যান্ড কোম্পানির খদ্দের হয়ে ওঠেন।
পন্ডিত রবি শঙ্কর বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসকে হেমেন এন্ড কোম্পানির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে, প্রাচ্য থেকে হেমেন এন্ড কো-র নাগাল পৌঁছে গেল পাশ্চাত্যেও। বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তার কৃতিত্ব এবং অবদানের জন্য, হেমেন সেন অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট দুটি হল ‘হাফিজ আলী খান পুরস্কার’ এবং ‘বিদ্যার্থী সম্মান’ পুরস্কার। রাসবিহারী মোড়ের মতো ব্যস্ত এলাকায় হেমেন অ্যান্ড কো দাঁড়িয়ে আছে নিজের ঐতিহ্য ও গর্ব নিয়ে। বহু মানুষ শুধুমাত্র এই দোকানের খ্যাতির টানে এখানে আসেন। স্থানীয় মানুষদের কাছে এটি একটি গর্বের বিষয়, আর সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তো এই দোকান আবেগ।
আজও দোকানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনুষ্কা শঙ্কর, রশিদ খান, আরতি মুখার্জি এবং আরও অনেকের নাম। এবং কেবল তার অতীত গৌরবই নয়, আজও এই দোকান সফলভাবে সঙ্গীতপ্রেমীদের প্রতিটি চাহিদা পূরণ করে চলেছে। হেমেন সেনের পুত্ররা তাঁদের বাবার উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলেছেন। তাঁদের যন্ত্র তৈরিতে ব্যবহার হয় বিশেষ চামড়া,কাআর কাঠ আসে অসম থেকে। কাঠের তৈরি বাদ্যযন্ত্রগুলির গন্ধ, গুণমানের প্রতি কারিগরদের একাগ্রতা এবং দোকানের কর্মীদের আন্তরিক ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করে। তবে, গল্প আছে, জর্জ হ্যারিসন যখন এসেছিলেন দোকানে, আলোর আড়াল হচ্ছে বলে সরে বসতে বলেছিলেন কারিগর হেমেন।
Discussion about this post