বসিরহাটের পাটালি আর নলেন গুড়ের সন্দেশ বাঙালির চিরন্তন দুর্বলতা। নাম শুনলেই মনে পড়ে যায় সেই ম-ম গন্ধ আর নরম গলে যাওয়া স্বাদ। কিন্তু আজকের দিনে বাজারে আসল পাটালি পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার। চকচকে সাদা রঙ দেখে আমরা ভেবে নিই, এটাই নিশ্চয় আসল ও ভালো মানের গুড়। অথচ বাস্তব হচ্ছে, এই সাদা পাটালির বড় অংশই তৈরি হয় চিনি আর ফিটকিরি দিয়ে। ফিটকিরির কারণেই রঙ ফ্যাকাসে বা একেবারে সাদা হয়, আর কখনও ভাগ বেশি পড়লে স্বাদে তিতকুটে লাগে। ব্যবসায়ীরা অবশ্য দায় চাপান “গাছের রস তিতো হয়ে যাচ্ছে” – এই গল্পে। কিন্তু ঘরে এনে যখন বুঝতে পারেন কোনও গন্ধ নেই, তখনই বোঝা যায় সত্যিটা অন্য জায়গায়। আসলে গন্ধহীন এই পাটালি মূলত চিনি-নির্ভর, খেজুরের রসের গুণ নেই বললেই চলে।

খেজুর গাছ থেকে রস বের করেন যাঁরা তাঁদের বলা হয় শিউলি। তাঁদের হাতেই নির্ভর করে আসল গুড়ের ভাগ্য। একেকটি গাছ থেকে সপ্তাহে তিনদিন রস মেলে। প্রথম দিনের রস – যাকে বলে জিরান রস, এটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও সুস্বাদু। আগের দিন বিকেলে নল লাগানোর পর ভোরে যখন শিউলি সেই রস সংগ্রহ করেন, তখন সূর্য ওঠার আগেই রস বাড়িতে পৌঁছে যায়। সেই জিরান রস জ্বাল দিতে দিতে যখন সরষে ফুলের মতো ফেনা ওঠে, তখন চাকি দিয়ে ঘষে তৈরি হয় অপূর্ব পাটালি। এই পাটালি শক্ত হয় না, আঙুলের টোকায় ভেঙে যায়। আর তার গন্ধেই একসময় পুরো পাড়া মাতোয়ারা হয়ে থাকত, অবশ্য এখনও কোথাও কোথাও হয়। দ্বিতীয় দিনের রসের গুণমান কম, আর তৃতীয় দিনের ‘ওলা রস’ দিয়ে তৈরি গুড় সাধারণত বাড়ির ক্ষীর বা গরুর খাবারেই ব্যবহৃত হয়। এই অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের রসেই সবচেয়ে বেশি মেশানো হয় চিনি আর ফিটকিরি, আর সেই নকল গুড়ই শেষ পর্যন্ত আমাদের থালায় এসে পড়ে।

এবার প্রশ্ন জাগে, যে জিরান রসের গুড় এত ভালো, তা বাজারে পাওয়া যায় না কেন? কারণ ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই শিউলিদের অগ্রিম দিয়ে রাখেন। রস উঠলেই প্রথম দিনের সেই উৎকৃষ্ট গুড় সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভিনরাজ্যে বা বিদেশে। তাই স্থানীয় বাজারে যা থাকে তা মূলত দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনের রসের পাটালি। আমরা যে গুণগত দিক থেকে দুর্দশাগ্রস্ত পাটালি কিনে খাই, সেটি সত্যিকারের খেজুরের গুড় নয় বললেই চলে।

নলেন গুড় নিয়েও বিভ্রান্তি কম নয়। বছরের প্রথম রস থেকে যে গুড় তৈরি হয়, তাকেই প্রকৃত অর্থে নলেন গুড় বলা হয়। তার স্বাদ অনন্য, দামও আকাশছোঁয়া – সেটি সাধারণত বাজারে মেলে না। আমরা যে ‘নলেন গুড়ের সন্দেশ’ খাই, তার ভেতরে বেশিরভাগ সময় থাকে ভেলি গুড়, রঙ কিংবা সুগন্ধির মিশেল। অথচ বসিরহাটে গেলে এখনও অনেক বাড়িতে পাওয়া যায় আসল জিরান রসের গুড়, যার দাম ২৫০-৩০০ টাকার মতো। ইছামতীর ব্রিজ পার হয়ে দু’পাশের কয়েকটি গ্রামে খোঁজ করলেই মিলবে সেই অমৃতসম পাটালি। তবে যতই লোভ হোক, সাদা রঙের ফিটকিরি দেওয়া পাটালি এড়িয়ে চলাই উচিৎ। শুধু স্বাদের ক্ষতি নয়, বিজ্ঞানীরা বলছেন, এতে ক্যানসারের মতো ঝুঁকিও থাকতে পারে। এখন আবার তাল পাটালির মৌসুম চলছে। তাই কেনাকাটায় সতর্ক থাকুন, চকচকে রঙ নয়, বরং বিশ্বাস রাখুন গন্ধ আর স্বাদের প্রতি।






































Discussion about this post