বাঙালির ঘরে বর্ষা আসে রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ-শব্দে ভর করে। বর্ষার রূপ দেখে মোহিত হয়েছেন কালিদাস, বিদ্যাপতি, রবীন্দ্রনাথ সকলেই। “এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর।” এই পংক্তি বারংবার বর্ষার রূপ নিয়ে ঢুকে পড়েছে বাঙালির উঠোনে। আর বর্ষার গন্ধ? খাদ্যরসিক বাঙালি ওদিক দিয়ে সব্বাইকে ছাপিয়ে গেছে। বর্ষা মানেই খিচুড়ি-ডিম ভাজা, আলুর চপ-পিঁয়াজি আর পদ্মার ইলিশের গন্ধে বাঙালির মন প্রাণ একেবারে লাফিয়ে ওঠে। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের আরো অনেক রাজ্যেই বর্ষার একটা বড় সমস্যা জল জমা। রাস্তা ঘাট তো জলে থৈ থৈ বটেই এমনকি বাড়ির উঠোনটাতেও গোড়ালি পর্যন্ত জল। একে অবশ্য বাঙালি কোনোদিন সমস্যা হিসেবে দেখেইনি।
![](https://dailynewsreel.in/wp-content/uploads/2023/07/1-min-60.jpg)
একান্নবর্তী বাঙালি পরিবারে হঠাৎই এক মেঘলা সকালে ঘোষিত হত ছুটি। বড়রা অফিস যাবে না, বাজার করবে না, আর ছোটোদেরও এই তালে তাল রেখে ইস্কুল ছুটি। আর মা কাকিমারা কম আয়োজনে রেঁধে ফেলবেন লোভনীয় খিচুড়ি। বাড়ির বড়োরা আড্ডায় ব্যস্ত, মা কাকিমারা ব্যস্ত রান্নায় আর বাড়ির বড়ো দাদা দিদিরা বৈষ্ণব পদাবলী বা রবীন্দ্রনাথ নিয়েই মশগুল। এমনাবস্থায় বাড়ির খুদে সদস্যরা কী করে? অন্যদিন যারা সারাক্ষণ তাদের পিছনেই পড়ে থাকে ভরা বর্ষায় তাদের পাত্তাই দেওয়া হচ্ছে না। যতদিন ছোটদের হাতে মোবাইল ফোন আসেনি অন্ততঃ ততদিন জল জমা বর্ষায় তাদের সময় কাটানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল কাগজের নৌকা।
![](https://dailynewsreel.in/wp-content/uploads/2023/07/3-min-19.jpg)
কাগজের নৌকার হদিস প্রথম মিলেছিল ১৪৯৮ সালে ইউরোপে। তারপর এই অরিগামি বিদ্যায় বিশ্বকে চমকিত করেছে চীন ও জাপান। কিন্তু ইউরোপের কাগুজে নৌকা যে হঠাৎ কীভাবে বাংলার শিশু সমাজের এমন জনপ্রিয় এক খেলনায় পরিণত হল তা বোধহয় কেউ বলতে পারবে না। এ খেলনার একটা বড় বিশেষত্ব হলো খেলনাটা অতিরিক্ত কম আয়োজনে নিজেরাই বানিয়ে ফেলা যায়। এমনকি লেখা পাতা ছিঁড়ে নৌকো বানানোর অপরাধে মার খাওয়া শিশুর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। স্কুল ফেরত বাচ্চারা হৈ হৈ করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাগজের নৌকা ভাসাতে ভাসাতে বাড়ি ফেরার দৃশ্য আজকাল বড়ই দুর্লভ। ছোটদের কাগজের খেলনা বলে তা কিন্তু খুব মামুলি নয়। এ নৌকার রকমফের আছে। দু’রকমের পালতোলা নৌকার গঠনই অবশ্য ছিল জনপ্রিয়। তারমধ্যে আবার হরদম চোখে পড়ত রঙিন তিনকোনা পাল তোলা নৌকা। ওই কাগজ ভাঁজ করতে করতেই ছোটরা শিখে ফেলত নৌকা যত ছোট হবে ততই মজবুত হবে। বড় নৌকা জলে বেশিক্ষণ ভাসতে পারে না, কাগজ যে।
![](https://dailynewsreel.in/wp-content/uploads/2023/07/2-min-36-1024x621.jpg)
কাগজের নৌকা এখন শুধুই বাঙালির নস্টালজিয়ায় বেঁচে। আজকাল নৌকো ভাসানোর জায়গার বড় অভাব। দশ তলার ফ্ল্যাট বাড়িতে বর্ষার জল জমে না যে।
চিত্র ঋণ – freepik.com
Discussion about this post