ভোজন প্রিয় বাঙালির খাদ্য তালিকা মিষ্টি ছাড়া যেন অপূর্ণ। আধুনিক সন্দেশ-রসগোল্লার বয়স মাত্র দুই-আড়াই’শ বছর হলেও বাঙালি ও মিষ্টির সম্পর্ক প্রায় দুই হাজার বছরের। মিষ্টির নাম শুনলে জিভে জল আসে না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। যার ফলে বাংলার প্রতিটি কোণায় মিষ্টিকে পণ্য করে গড়ে উঠেছে অগণিত নামী-দামী মিষ্টি বিক্রয়কেন্দ্র। বাঙালির এই মিষ্টি তালিকার অন্যতম আকর্ষণ স্বাদ ও গঠনে ভিন্ন ‘মনোহরা’। কলকাতার রসগোল্লা, শক্তিগড়ের ল্যাংচা কিংবা বর্ধমানের মিহিদানা ও সীতাভোগের মতোই সমান জনপ্রিয় ‘জনাইয়ের মনোহরা’।
হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন ‘জনাই’। সেখানে নেমে কাউকে জিজ্ঞেস করে খুব সহজেই পৌছে যাবেন মনোহরার স্বাদ নিতে। মনোহরার ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন। জনাইয়ের রেখা বিশ্বাস বলেন, “মনোহরা নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলেন। কেউ বলেন একজন ইংরেজ কলকাতা থেকে জনাই এসেছিলেন, তিনিই নাকি এই মিষ্টির আবিষ্কর্তা। আমরা তো আবার শুনেছি, কলকাতার ভীমচন্দ্র নাগ নাকি এখানকার ময়রা পাড়াতে থাকতেন, তাই ওঁর বংশধররাই এই মিষ্টি প্রচলন করেন।”
মনোহরা তৈরিতে প্রথমে ছানা আর চিনি দিয়ে তৈরি করা হয় সন্দেশের মিশ্রণ। তারপর কিছুটা করে মিশ্রণ হাতের তালুতে নিয়ে গোল্লা পাকানো হয়। তারপর তা বিভিন্ন সুগন্ধি মশলা সহকারে চোবানো হয় গরম চিনির রসে। এরপর খানিক সময়ের অপেক্ষা। সবশেষে গোলাকার নরম পাকের সন্দেশের চারধারে চিনির মোড়ক দেওয়া হয়। এই মিষ্টির বিশেষত্ব হলো চারিধারের এই চিনির আস্তরণ। শীতকালে এর স্বাদ আরও বেড়ে যায়, তখন চিনির জায়গায় জুড়ে বসে গুড়ের মোড়ক।
মনোহরা, অর্থাৎ মন হরণ করে যে। জানা যায়, এক সময় উত্তমকুমার কিংবা ছায়াদেবীর মতো বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক-নায়িকারাও শুট করে কলকাতা ফেরার পথে প্রায়ই গাড়ি থামাতেন জনাইয়ের দোকানে। শোনা যায়, স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ও নাকি এই মনোহরা খেতে খুব ভালোবাসতেন। মোহিতলাল মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বলতেন, “তোরা মিষ্টির নাম রাখিস প্রাণহরা, আর আমরা নাম রাখি মনোহরা।” ঢাকার মিষ্টি প্রাণ হরণ করলে, বাংলার মিষ্টি মন হরণ করবে নাই বা কেন! সময়ের সাথে সাথে মনোহরার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও। বর্তমানে মনোহরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং জার্মানিতেও রপ্তানি হয়ে থাকে। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সেই বিখ্যাত ভোলা ময়রা থেকে নবীন চন্দ্র দাস – যুগে যুগে এঁদের হাতের জাদুতেই বাঙালির আবেগের অপর নাম হয়ে উঠেছে মিষ্টি। ঘরে তৈরি নারকেল নাড়ু থেকে শুরু করে আজকের দিনের নানা রকম বাহারি মিষ্টি, সব কিছুতেই রয়েছে বাঙালির রসনা তৃপ্তির কাহিনী।
Discussion about this post