মিষ্টি যদি না থাকে শেষ পাতে, তাহলে আর মন ভরলো কীসে? ভোজন রসিক বাঙালির তো আবার চাই হরেক রকম মিষ্টি। কোথাও রসে টইটুম্বুর রসগোল্লা, তো কোথাও শুকনো সন্দেশ। জয়নগরের মোয়া থেকে শুরু করে বেলকোবার চমচম, এই ‘মিষ্টি’ তালিকা কিন্তু কখনো শেষ হওয়ার নয়। তবে হরেক রকমের সেই মিষ্টির স্বাদ ও গঠন পরিবর্তন হয়েছে ভৌগোলিক অবস্থানের সাথে সাথে। এই তো খাস বাঁকুড়া জেলাতেই কত ধরনের মিষ্টি! ছাতনার প্যাড়া, বিষ্ণুপুরের মতিচুরের লাড্ডু আর বেলিয়াতোড় এর মেচা সন্দেশ। তারা স্বাদেও যে একে অপরকে টেক্কা দেয়!
দুর্গাপুর থেকে বাঁকুড়া সদর যাওয়ার পথে পড়বে বেলিয়াতোড় গ্রাম। হ্যাঁ ,হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন এখানেই তো জন্ম বাংলার নিজস্ব বিখ্যাত চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের। কিন্তু মশাই, বেলিয়াতোড়ে গিয়েছেন অথচ মেচা সন্দেশের স্বাদে ভোলেননি এমনটা হয়না। ‘মেচা সন্দেশ’,লোকমুখে ম্যাচা। এই সন্দেশ কিন্তু আর পাঁচটা সন্দেশের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। সন্দেশ নয় বরং মনোহরার সাথে ম্যাচাকে গুলিয়ে ফেলা যেতে পারে।
মেচা সন্দেশের আগমন সেই মল্লরাজের শাসনকালে।জনশ্রুতি আছে,সপ্তদশ শতক নাগাদ তাদের এলাকায় দেখা যায় দুধের ঘাটতি। অথচ মল্ল রাজাদের পাতে মিষ্টি চাই-ই চাই! অগত্যা, রন্ধনশিল্পীকে খুঁজতে হলে বিকল্প। ছোলার বেসন, ময়দা আর গুড় দিয়ে তৈরি করলেন এক ভিন্ন স্বাদের মিষ্টি। চিনির রসে মোড়ানো এ মিষ্টির নাম দেওয়া হল ‘মেচা সন্দেশ’। আবার অনেকের মতে, গিরীশচন্দ্র মোদকই প্রথম প্রস্তুত করেন এই ম্যাচা। বর্ষাকালে বাবা ধর্মদাসের মেলায় তিনি পসরা সাজাতেন মিষ্টির। কিন্তু বর্ষার আর্দ্র আবহাওয়ায় তাঁর তৈরি গুড়ের লাড্ডু নষ্ট হয়ে যেত সহজেই। সুতরাং, বেছে নেওয়া হল অন্য পথ। এক নতুন ধরনের মিষ্টি তৈরি করতে হবে, দেখতে হবে লাড্ডুর মতই কিন্তু স্বাদে হবে ভিন্ন। ছোলার বেসন, ক্ষীর আর দেশি ঘি দিয়ে কড়া পাকে তৈরি হল এই মিষ্টি। ওপর থেকে চিনির রস দেওয়া হয় ফলে, শুকিয়ে গেলে একে দেখতে অনেকটা উল্টোনো কলসীর মত মনে হয়। আর স্বাদে নিঃসন্দেহে অপূর্ব!
২০০ বছরের পুরনো এই মিষ্টি, এখনো বেলিয়াতোড়ের গর্ব। কমবেশি সব দোকানেই পাওয়া যাবে এই বিশেষ সন্দেশ। প্রতি মিষ্টির দাম ৫ থেকে ১০ টাকা। তবে মিষ্টি প্রস্তুতকারকদের দীর্ঘদিনেরই দাবি রসগোল্লার ন্যায় একেও দেওয়া হোক জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ। জি.আই ট্যাগ পেলে ক্রেতা মহলে এই মিষ্টির কদর বাড়বে আরও অনেকখানি। একসময় মল্ল রাজাদের প্রিয় ছিল যে মিষ্টি, সেখানে তো বিশেষ কিছু থাকতেই হয়! তাহলে আর কী? খাওয়ায় পাতে এবার একদিন চেখে দেখাই যায় বেলিয়াতোড়ের এই বিখ্যাত ‘মেচা সন্দেশ’।
Discussion about this post