বাংলার শীতের স্বাদ বলতে প্রথমেই যে নামটি মনে পড়ে, তা হল নলেন গুড় – ঝোলাগুড় ও পাটালি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যার জনপ্রিয়তা এখন এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতি বছরই বিদেশে রপ্তানির বড়সড় বরাত আসে। কিন্তু এবারের মরশুমে ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ! আন্তর্জাতিক বিমানে ঝোলাগুড় তোলার অনুমতি নেই। গত বছর যেখানে কোনো বাধা ছাড়াই পাটালি ও ঝোলাগুড় দু’টিই প্লেনে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এ বছর কুরিয়ার সংস্থাগুলির তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আন্তর্জাতিক পরিবহনে নলেন গুড়ের তরল অংশ নিষিদ্ধ। ফলে বিদেশে থাকা বাঙালিদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পাঠানো যাচ্ছে শুধু পাটালি। ফিনল্যান্ড, দুবাই, সিঙ্গাপুরে ইতিমধ্যেই পাটালি পৌঁছে গেছে, এবার যাচ্ছে থাইল্যান্ডেও। আরও বরাত আসতে শুরু করলেও ঝোলাগুড়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা রপ্তানির ব্যবসায়ে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে।
এদিকে দেশীয় বাজারেও চাহিদা আকাশছোঁয়া, কিন্তু সরবরাহ তুলনায় কম। শীত আসতে দেরি হওয়ায় রস সংগ্রহের সময় কমে গেছে, ফলে উৎপাদনেও প্রভাব পড়েছে। গুড় প্রস্তুতকারকদের ভাষায়, এ বছর ‘শিউলি’ সংখ্যা কমে যাওয়াই মূল সমস্যা। যেখানে আগে প্রায় হাজারখানেক শিউলি মিলে একসঙ্গে রস সংগ্রহ করা হত, সেখানে এবার তা নেমে এসেছে মাত্র তিন-চারশোতে। যদিও গুণমানের দিক থেকে বড় কোনও ঘাটতি নেই, তবে উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় বাজারে দামের চাপ দেখা দিয়েছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ড থেকে ভালো মানের দানা গুড় এসেছে। মুর্শিদাবাদের এসটি সুপার, দেবীপুরের শক্ত পাটালি, টাকি ধোবাপাড়ার থালা পাটালি – সবই এ বছর বাজারে প্রশংসা কুড়োচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ লাগোয়া হরিশনগর, বিজয়পুর ও গেদে এলাকা থেকে আসা গুড়ের মান এবার বিশেষভাবে ভালো বলেই জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে পরিবহনের ক্ষেত্রে বৈপরীত্যও চোখে পড়ছে। দেশের ভেতরে পাটালি ও ঝোলাগুড় দু’টিই বিমান ও ট্রেনে নির্বিঘ্নে পাঠানো যাচ্ছে। বড় বরাত হলে ট্রেনই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে বিমানের ওপরই ভরসা করতে হয়। তাই ঝোলাগুড় নিষিদ্ধ হওয়ায় বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পূরণ করা যাচ্ছে না অর্ডার। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এ বছর হয়তো বিদেশের বাঙালিরা নলেন গুড়ের আসল স্বাদ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবেন। তবে তাদের আশা, নিয়ম শিথিল হলে আবারও আকাশপথে উড়তে পারবে বাংলার ঝোলাগুড়, আর ততদিন পাটালিই বিদেশে বাংলার মিষ্টির দূত হয়ে থাকবে।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – Gearless Travel Diaries-র ফেসবুক পেজ






































Discussion about this post