মেহেরপুরে প্রাচীন সময়ে কাশারি বাজারে গড়ে ওঠে ছোট্ট এক দোকান ‘বাসুদেব এন্ড গ্র্যান্ড সন্স’। নামের ইংরেজি ছোঁয়া ছাপিয়ে ভেতরে গেঁথে আছে শতবর্ষ পুরনো এক বাঙালি ঐতিহ্য। ১৮৬১ সালে বাসুদেব সাহা নামে এক স্থানীয় কারিগর নিজের বাড়ির আঙিনায় খড়ের চালা আর টিনের ঘর তুলে শুরু করেছিলেন মিষ্টির ব্যবসা। তখনকার দিনে বাড়ির তৈরি ছানার মিষ্টি বিক্রি করা তেমন কোনো বড় ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তাঁর হাতে তৈরি সাবিত্রী আর রসকদম্ব হয়ে উঠল স্বাদের এক নিজস্ব ঘরানা।

রসকদম্ব এই নাম শুনলেই চোখে ভাসে একটি ছোট, গোল, রসালো মিষ্টি। কিন্তু এর আসল চমক লুকিয়ে থাকে তার তৈরি পদ্ধতিতে। বাইরে থেকে দেখতে যতটা সাদামাটা, ভেতরে ততটাই জটিল এক কারিগরি। প্রথমেই খাঁটি ছানা তৈরি করা হয় গাভীর দুধ থেকে। সেই ছানা দিয়ে বানানো হয় ছোট ছোট গোল্লা, যা রসগোল্লার মতো হলেও ভেতরে এক ফোঁটা রস থাকে না। অতিরিক্ত আর্দ্রতা ঝরিয়ে নেওয়ার পর, প্রতিটি গোল্লাকে ঢেকে ফেলা হয় খোয়া আর চিনি মেশানো এক বিশেষ মিশ্রণ দিয়ে। শেষ ছোঁয়া হিসেবে চিনি মাখানো পোস্ত দানায় ঢাকা পড়ে তার গা, যেন একেকটি ছোট কদমফুল। খোসাটায় হালকা খসখসে ভাব, আর ভেতরের স্বাদ নরম ও মোলায়েম। কোনো অতিরিক্ত মিষ্টতা নেই, শুধু পরিমিত এক স্বাদের ভারসাম্য।

এই মিষ্টি তৈরির প্রতিটি ধাপে আজও রয়ে গেছে পুরোনো সেই রান্নাঘরের ঘ্রাণ। আধুনিক যন্ত্র নয়, বরং মানুষের হাত বদলেই তৈরি হচ্ছে রসকদম্ব। প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু হয় দুধ জ্বালানো, ছানা তৈরি, গোল্লা বানানো, খোয়া-মিশ্রণ প্রস্তুত করা, আর তারপর রাতভর তা ঠান্ডা রেখে ভোরবেলা প্যাকেট করা। প্রতিদিন গড়ে বিশ থেকে ত্রিশ কেজি রসকদম্ব প্রস্তুত হয়, তবে তা দোকানে সাজিয়ে রাখার জন্য নয়। অগ্রিম অর্ডার নেওয়ার পরেই শুরু হয় তার নিবিড় প্রস্তুতি। তবে অর্ডার ছাড়াও বিশেষ প্রয়োজনে বা অনুরোধে এক থেকে দুই কেজি পাওয়া গেলেও যেতে পারে এবং তাও দুপুরের হতে না হতেই সব বিক্রি হয়ে যায়।

মেহেরপুরবাসীর হৃদয়ে, এটি শুধুই মিষ্টান্ন নয়, যেন প্রিয় কোনও চেনা গন্ধ। এ যেন স্মৃতি-সংস্কৃতি ও আতিথেয়তার প্রতীক। বিয়ে হোক বা অতিথি আপ্যায়ন, সাবিত্রী আর রসকদম্ব না থাকলে কিছুই যেন পূর্ণতা পায়না। এমনকি যারা বিদেশে থাকেন, তাঁরাও দেশে ফিরলে এই স্বাদের টানেই ছুটে আসেন বাসুদেব এন্ড গ্র্যান্ড সন্সে। এখন দোকান চালান বাসুদেব সাহার নাতি বকুল সাহা এবং তাঁর দুই ভাই। প্রজন্ম বদলেছে, সময় পাল্টেছে, কিন্তু বদলায়নি ঐতিহ্যের স্বাদ। তাঁদের বিশ্বাস, রসকদম্ব শুধুই মিষ্টি নয় এটি এক ঘরানার গরিমা। তাদের আরেক সৃষ্টি ‘সাবিত্রী’ অর্থাৎ সতী নারীর প্রতীক, তেমনি তাদের মিষ্টির প্রতিটি স্তরে আছে সততা, নিষ্ঠা, আর ভালোবাসার ছোঁয়া। তবে এই দীর্ঘদিনের মিষ্টি তৈরির ধারায় এখন এসেছে নানা সংকট। দুধ, চিনি ও পোস্তদানার দাম ক্রমশ বাড়তে থাকায় খরচ বেড়েছে, কিন্তু ঐতিহ্যের স্বাদ ধরে রাখতে তাঁরা সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের কথা ভেবে এখন মূল্যবৃদ্ধিতে হাত দিতে চান না।
মেহেরপুরের মানুষদের মুখে এই মিষ্টির স্বাদ রয়ে গিয়েছে, তেমনি হৃদয়ে রয়ে গেছে এক টুকরো গর্ব। সেই গর্ব বলে দেয় এই শহর শুধু ইতিহাসে নয় স্বাদেও অতুলনীয়।
Discussion about this post