‘গাট্টা’ শব্দে রয়েছে ভয়ের সহাবস্থান। স্কুলবেলার অঙ্ক স্যার হোক বা রাশভারী হেডমাস্টার মশাই! গাট্টার প্রকরণে জাত চেনাতেন প্রত্যেকেই। আশি-নব্বই দশকে গাট্টাহীন ছাত্রবেলা ছিল দুর্লভ। তা খেতে কঠিন হলেও স্মৃতিমধুর। এহেন গাট্টার দাপটে চাপা পড়ে গেছে আর এক গাট্টার স্বাদ। তাকে খেতে মিষ্টি, চিবোতে কড়া। স্থানভেদে রয়েছে তার নামভেদ। তবে দুই বাংলার মানুষের ছেলেবেলা জুড়ে লেগে আছে তার মিষ্টি স্বাদ। স্কুলগেটে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে হোক বা বাড়ির লোহা ভাঙা, টিন ভাঙা দিয়ে হোক! গাট্টা প্রায় সকলে খেয়েছি। তখন তো আর পাড়ার দোকানে আধুনিক চকোলেটের সম্ভার মিলতো না। তাই নব্বই দশক চকোলেটের স্বাদ হিসেবে মনে রেখেছে গাট্টাকে। এর পোশাকি নাম হানিকম্ব। কেউ তাকে ডাকে গুড়ের মটকা নামে। বাংলাদেশের কালীগঞ্জে সে পরিচিত গাট্টা নামে। বাংলার অন্যত্র তাকে কটকটি নামে চেনে কেউ কেউ।
এহেন মিষ্টি আগে পাওয়া যেত ফেরিওয়ালার কাছেই। বাড়ির ফেলনা জিনিস বা সামান্য পয়সায় বিনিময়েই পাওয়া যেত তা। এর প্রধান আকর্ষণ শুধুই মিষ্টি স্বাদ নয়। চিবোনোর সময় দাঁতে দাঁতে লেগে যায় এটি। অনেকটা চুইংগামের মতো অনুভূতি আসে মুখে। এই কারণে তখনকার বাচ্চাদের ভীষণ প্রিয় ছিল এটি। এমনকি গর্ভবতী মহিলাদের কাছেও এ ছিল তুমুল জনপ্রিয়। এখন আর নেই ফেরিওয়ালার ঝুলি। শৈশব মেতে আছে রঙিন র্যাপারে মোড়া রকমারি চকোলেটের স্বাদে। তবে রসনার রোমন্থন এখনও সম্ভব। কিছু সংস্থা রেখেছে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা। অর্ডারে মিলবে প্রাচীন স্বাদ।
তালের গুড় দিয়ে গাট্টা তৈরীর হয়। সেই গুড় হতে হবে বিশুদ্ধ ও উন্নতমানের। তালের গুড় ও সোডিয়াম বাই কার্বনেট এর মূল উপকরণ। নান্দনিকতা বজায় রাখতে লাগে মৌরিদানা বা ভাজা বাদাম। এগুলো গাট্টার উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘরোয়াভাবেও বানানো যেতে পারে একে। বাই কার্বনেটের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায় ইনো জাতীয় ওষুধ। স্বাদে উন্নত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে ঘি। আগে ভাদুঘর, খাঁটিহাতা ইত্যাদি এলাকার বেশিরভাগ মানুষ গাট্টা ফেরি করে দিন গুজরান করতো। এখন তাদের কেউই পুরনো পেশায় জড়িয়ে নেই। কারণ হিসেবে তাঁরা দাবি করেন উন্নত গুড়ের অভাব। তাঁদের মতে, এখন যে গুড় পাওয়া যায় তাতে মিশে থাকে চিনি। যা থেকে মেলে না গাট্টার সঠিক স্বাদ। আগে প্রতিদিন প্রায় সাত আট মন গাট্টা তৈরি হতো। মাসিক আয় ছিল পঞ্চাশ হাজার মতো। এখন সেসব দিন অতীত।
বাঙালির রসনা বড়ই অনির্দেশ্য। স্বাদকোরকেরা সবসময় যে নতুনের খোঁজ করে তা নয়। কখনও সে মেতে ওঠে প্রাচীন স্বাদবিলাসে। তাই জিভের দিকে তাকিয়ে আবার ফেরানো যায় ফেরিওয়ালার গাট্টা মিঠাই। এতে যে শুধু রসনাতৃপ্তি হবে তা নয়। সুবিধা হবে রুজি রোজকারেরও। তাই গাট্টা যদি আবার ফেরে জিভে! সে প্রত্যাবর্তন হবে রাজার মতোই। এজন্য চাই সঠিক উদ্যোগ। তাই প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাত করার সঠিক সংকল্পের অপেক্ষায় রয়েছে গাট্টা। দুই বাংলা জুড়ে কি তবে সত্যিই ফিরে আসবে হারানো স্বাদ!
Discussion about this post