বাঙালি সারাবছর উৎসবে মেতে থাকে। আর সেই সব উৎসবগুলোর যোগফল করলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তার চেয়েও বেশী আনন্দ মেলে এই দুর্গা পুজোতে। কলকাতার সাথে সাথে জেলার পুজো গুলোর সাথেও অনেক সময় জড়িয় থাকে কিছু তাক লাগানো গল্প। আসুন তাহলে আজ হাওড়ার শিবপুরের রায় চৌধুরী বাড়ির দুর্গা পুজোর কথা জেনে নেওয়া যাক। সাবেকিয়ানা আর ঐতিহ্যের অপরূপ মেলবন্ধন এ পুজো। আনুমানিক ৩৪০ বছর ধরে চলে আসছে এই দুর্গা পুজো।
এ বাড়ির পুজোর ইতিহাস আমাদের নিয়ে যায় সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে। দিল্লির সিংহাসনে তখন বসে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব আর বাংলাতেও তখন চলছে নবাবি শাসন। সেই সময় ১৬৬২ সালে বর্তমান রায় চৌধুরী বংশের পূর্বপুরুষ রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী হাওড়ার বেশ কয়েকটি গ্রামের মালিকানা পান মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে। সেই গ্রামগুলির মধ্যে শিবপুরও ছিল। বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর থেকে রায়চৌধুরী উপাধি পাওয়ার পর থেকেই শতকের পর শতক এই পদবি ব্যবহার করে আসছেন ওই বংশের সদস্যরা। রায়চৌধুরী বাড়িতে দুর্গা পুজা শুরু হওয়ার সঠিক সময় নিয়ে মতভেদ থাকলেও ১৬৮৫ সাল থেকেই পুজো শুরু হয় বলেই মনে করা হয়। রায় চৌধুরী বাড়ির সুপ্রাচীন ঠাকুর দালানটিই তার প্রমাণ।
একটা সময়ে এই পরিবার দেবী চণ্ডীর ভক্ত ছিলেন। রাজা রামব্রহ্ম রায় চৌধুরীর শিশুকন্যা প্রতিদিন বাড়ি সংলগ্ন বাগানটিতে তার বন্ধু পদ্মাবতীর সঙ্গে খেলত। জমিদার বাড়ির কেউ পদ্মাবতীকে দেখেননি। প্রতিদিনই নিজের কন্যার মুখ থেকে তার বন্ধু পদ্মাবতীর সম্পর্কে নানান গল্প শুনে রামব্রহ্মের একদিন ইচ্ছা হলো পদ্মাবতীর সাথে দেখা করার। মেয়ের খেলার ফাঁকে একদিন তিনি নিজেই হানা দেন পদ্মাকে দেখতে। কিন্তু তিনি সেখানে পৌঁছনোর আগেই পদ্মা সেই স্থান ছেড়ে চলে যায়। আদতে পদ্মা বলে কেউই নেই বলে ভেবে নেন রামব্রহ্ম। কিন্তু বাগানের নরম মাটিতে পায়ের ছাপ তার ধারণা ভুল প্রমাণ করে। সেদিন রাতেই রাজা রামব্রহ্ম রায় চৌধুরী স্বপ্নাদেশ পান যে তার কন্যার সখী সেই পদ্মাবতী আর কেউ নয় দেবী দুর্গা। মনে করা হয় সেই থেকেই মায়ের পুজো শুরু।
এখনও প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই দুর্গা পুজো হয় সাঁঝের আটচালায়। পুজোর আগে কৃষ্ণনবমী তিথি থেকেই শুরু হয়ে যায় রায়চৌধুরী বাড়ির দেবী দুর্গার আবাহন। এইভাবেই সেই মুঘল জমানার পুজোর সাক্ষী থাকে আজও হাওড়ার শিবপুরের রায় চৌধুরী বাড়ি। তবে যদি শিবপুর রায় চৌধুরী বাড়ির প্রতিমা দর্শন করতে চান তাহলে? হাওড়া স্টেশন থেকে খড়গপুর বা মেদিনীপুর লোকাল ধরে রামরাজাতলা স্টেশন। তারপর টোটো বা বাসে শিবপুর বাজার থেকে মন্দিরতলার দিকে এগোলেই হিন্দু গার্লস স্কুল। সেখান থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরে মিনিটখানেকের হাঁটা পথেই দেখা মিলবে সাঁঝের আটচালার।
Discussion about this post