তাজমহল! পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য, ভারতীয়-তুর্কী-পারসিক-ইসলামিক শৈলীর সংমিশ্রণে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধকে বলা হয় ‘ভালোবাসার প্রতীক’। সম্রাট শাহজাহান তাঁর প্রিয় স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এটি স্থাপন করেন। মুঘল স্থাপত্যের সর্বোত্তম এই নিদর্শন তৈরী হয়েছিল ২২ বছর ধরে। তবে চাঁদের কলঙ্কের মতই, সময়ের সাথে সাথে এ হেন ঐতিহাসিক সৌধ ও তার জন্মদাতা সম্রাটকে ঘিরেও উঠেছে একাধিক প্রশ্ন। শুধুই কি নির্ভেজাল ভালোবাসা? নাকি আড়ালে রয়ে গেছে অন্য কিছু? কেমন ছিলেন মানুষ ও শাসক শাহজাহান? ঐতিহাসিকদের গবেষণায় উঠে এসেছে অজানা এমন অনেক তথ্য, যা জানলে শিহরিত হবেন আপনিও!
বাবর, হুমায়ূন, আকবর এবং জাহাঙ্গীরের পরে পঞ্চম মুঘল সম্রাট ছিলেন শাহজাহান। তাঁর শাসনকালকে বলা হয় ‘স্বর্ণযুগ’। তবে লেখক ভাসি শর্মার ‘দ্য নেকেড মুঘলস্’ বই থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবরের শাসনকাল পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্য ধার্মিক আচরণ এবং সুশাসনের জন্য পরিচিত হলেও, শাহজাহানের সময়ের চিত্রটি ছিল কিছুটা ভিন্ন। এই মুঘল সম্রাট আসলে ছিলেন একজন জঘন্য ও বিকৃত যৌনচাহিদা সম্পন্ন মানুষ! ‘ভালোবাসার প্রতীক’-এর নির্মাতার কার্যকলাপ জানলে আপনিও প্রশ্ন করতে বাধ্য হবেন, এ কেমন ভালোবাসা!
ইতিপূর্বেই বিবাহিতা সুন্দরী আরজুমান্দ বেগমের দৈহিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন যুবক শাহজাহান। শীঘ্রই তাঁর প্রথম স্বামীকে হত্যা করে তাঁর সঙ্গে বাগদান সম্পন্ন করলেও, বিয়ে করেননি তখনই। বরং তাঁর অগোচরেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পারস্যের রাজকন্যাকে বিয়ে করেন শাহজাহান। এর এক বছর পরে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হলে ‘আরজুমান্দ’ পরিবর্তন করে শাহজাহান তাঁর নামকরণ করেন ‘মমতাজ মহল’। মমতাজকে বিয়ে করার পরেও নাকি আরও তিনটি বিয়ে করেছিলেন সম্রাট। এমনকি, মমতাজের মৃত্যুর পর মমতাজের ছোট বোনকে বিয়ে করেন তিনি! সম্রাটের ১৪ তম সন্তানকে প্রসবকালে মমতাজের মৃত্যু ঘটলেও, সম্রাটের নির্বুদ্ধিতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণই ছিল পরোক্ষভাবে দায়ী৷ গর্ভবর্তী মমতাজকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যুদ্ধযাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। হাতির পিঠে বসে দুর্গম রাস্তা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ চলায় সময়ের পূর্বেই মমতাজের প্রসব বেদনা শুরু হয়। দীর্ঘ ৩০ ঘন্টা যন্ত্রণাভোগ করে সন্তান জন্ম দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু ঘটে তাঁর। নিজের ভুল বুঝতে পেরে আক্ষেপ-অনুতাপে এক বছর কাটানোর পর স্ত্রীর সমাধির উপরেই সম্রাট নির্মাণ শুরু করেন তাজমহল।
শুধু স্ত্রীই নয়, শাহজাহান অন্যায় করেছেন তাঁদের বড় কন্যা জাহানারার সাথেও। জাহানারার প্রেমিককে একেবারেই পছন্দ করতেন না তিনি। গোপনে দেখা করতে গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত সম্রাটের হাতে ধরা পড়ে যান তাঁরা। যমুনার তীরে একদিকে যখন চলছিল প্রেমের তাজমহলের নির্মাণ কাজ, তখনই অন্য দিকে মেয়ের চোখের সামনেই তাঁর প্রেমিককে নৃশংসভাবে খুন করেন শাহজাহান। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, তাজমহলের সঙ্গে মমতাজের প্রতি সম্রাটের ভালোবাসার কোন সম্পর্কই ছিল না। স্থাপত্য নির্মাণের নেশায় বুঁদ সম্রাট আসলে স্থাপত্যের মাধ্যমেই অমর হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। মমতাজের মৃত্যু ছিল তাঁর এই স্বপ্নপূরণের অজুহাত মাত্র।
তবে এই সবকিছুর সত্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, শেষ জীবনে তাঁর দুর্দশা যেন কর্মফলকেই ইঙ্গিত করে। তাজমহল নির্মাণে বিপুল অর্থব্যয়ের ফলে খালি হয়ে যায় রাজকোষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় সাম্রাজ্যকে ঠেলে দেয় দুর্ভিক্ষের পথে। ১৬৫৭ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে একদিকে জ্যেষ্ঠপুত্র দারা শিকো ও অপরদিকে অন্য দুই পুত্র ঔরঙ্গজেব এবং মুরাদের মধ্যে এক বছর ব্যাপী চলে সামুগড়ের যুদ্ধ। অবশেষে নিজের ছেলে ঔরঙ্গজেবের হাতেই বন্দী হন সম্রাট। এমনকি শাহজাহানের মৃত্যুর পর তাঁর রাষ্ট্রীয় সমাধিক্ষেত্র বানানোর খরচাটুকু করতেও রাজি হননি ঔরঙ্গজেব। বেগম মমতাজের ঠিক পাশেই কবর দেওয়া হয় তাঁকে, বিতর্কিত সেই ভালোবাসার প্রতীক তাজমহলেই।
Discussion about this post