সরকারিভাবে স্বীকৃতি প্রাপ্তি হলেও, পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের বৃহন্নলা সমাজ এখনো ভারতীয় সমাজের মূল স্রোত থেকে অনেকটাই ব্রাত্য। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হওয়ায় এই মানুষদের অনেক সময় অনেক বৈষম্য সহ্য করে নিতে হয় সমাজে। সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অভাবের পাশাপাশি সরকারি সুযোগ থেকেও তারা অনেকাংশেই বঞ্চিত থাকেন। শিক্ষা হোক বা স্বাস্থ্য, সবদিকেই অনেক সমস্যায় পড়েন এই মানুষরা। এই সবের সাথে লড়াই করে কেমন আছেন বাংলার বৃহন্নলারা?
এই সমাজের মানুষদের লড়াইকে তুলে ধরতেই এবার রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ড. তাপস পালের তত্ত্বাবধানে গবেষক জয়জিৎ দেবনাথ উত্তরবঙ্গের এই বৃহন্নলা সম্প্রদায় নিয়ে নিজের পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। গবেষণাটি দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, মালদা, কোচবিহার সহ আটটি জেলার ৩৩৩ জন বৃহন্নলা এবং ১৯টি আখড়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান নিয়ে করা হয়।
এই গবেষণায় উঠে এসেছে, বৃহন্নলাদের শিক্ষার হার অত্যন্ত নিম্ন, মাত্র ১.২৭%। তাদের মধ্যে মাত্র একজন এমবিএ এবং একজন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। অধিকাংশই সামাজিক বৈষম্যের কারণে ভিক্ষাবৃত্তি বা বিনোদনমূলক পেশায় বাধ্য হন। ১০০ দিনের কাজের মতো সরকারি প্রকল্পে তাদের অংশগ্রহণের হার শূন্য। বৃহন্নলাদের জনবসতি প্রধানত শহরের প্রান্তে বা গ্রামাঞ্চলের শেষে। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে কোনো আখড়া নেই। কারণ তাদের জীবনধারা পরিব্রাজন নির্ভর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে তা অসুবিধাজনক।
অধ্যাপক তাপস পালের মতে, বৃহন্নলাদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চাকরিতে সংরক্ষণ, পৃথক টয়লেট এবং হাসপাতালে নির্দিষ্ট ওয়ার্ড প্রয়োজন। এছাড়াও তিনি ‘তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন ব্যাঙ্ক’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশবে বৃহন্নলারা যৌন হয়রানি, মানসিক নিপীড়ন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। বৃহন্নলাদের আইনগত সহায়তাও সীমিত। তাদের জন্য একটি ‘তৃতীয় লিঙ্গ দিবস’ উদযাপনের প্রস্তাবও উত্থাপন করেছেন গবেষক।
মুঘল আমলে কর সংগ্রাহক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বৃহন্নলাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা তুলে ধরে গবেষকরা বলেছেন, বর্তমানেও তাদের কর বিভাগে চাকরি দেওয়া যেতে পারে। ড. পাল তার ব্যক্তিগত সঞ্চয় দিয়ে কোপাই নদীর তীরে বৃহন্নলাদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছেন বলেও জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্য প্রত্যাশা করেন তারা। বৃহন্নলা সম্প্রদায়ের বড়মা সোনামনি শেখ জানিয়েছেন তারা ভীষণ ভাবে আপ্লুত, ও তারা সম্মানিত বোধ করছেন এই সমাজের চোখে। এই গবেষণা বৃহন্নলা সম্প্রদায়ের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে এবং তাদের সঠিক অধিকার নিশ্চিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
Discussion about this post