কথায় বলে, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। খাবারের মেনুতে ভাত ও মাছ প্রায় প্রতিটি বাঙালির মনেই এক আলাদা তৃপ্তি আনে। তবে বাঙালির খাদ্যতালিকার অন্য একটি পছন্দের খাবার মিষ্টি। বাঙালির কোনো উৎসব কিংবা অনুষ্ঠানই মিষ্টি ছাড়া পূর্ণতা পায় না। দুগ্ধজাত দ্রব্যযোগে তৈরি নানান ধরনের মিষ্টি, মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির অতি পছন্দের। তবে রসগোল্লা, পান্তুয়া কিংবা নানা ধরণের সুস্বাদু সন্দেশের ভিড়ে আজও বাঙালির মনের অনেকটা জায়গা দখল করে আছে ভিন্ন পদ্ধতিতে তৈরী অন্যরকম স্বাদের ‘কাঁচাগোল্লা’।
কলকাতা থেকে ৭৮ কিমি দূরে, হাওড়া-কাটোয়া ট্রেন পথের একটি উল্লেখযোগ্য স্টেশন সোমড়াবাজার। কাঁচাগোল্লার প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে, এই সোমড়াবাজারের নাম। কারণ সোমড়াবাজারের খ্যাতি ঐ কাঁচাগোল্লার কারণেই ! সোমড়াবাজারে এমন কোন মিষ্টির দোকান নেই যেখানে কাঁচাগোল্লা পাওয়া যায় না। কাঁচাগোল্লার জন্ম ইতিহাস নিয়ে রয়েছে নানান মতভেদ। কারও মতে, সোমড়াবাজারেই কাঁচাগোল্লার সৃষ্টি। তবে অনেকের মতে, এই মিষ্টির জন্ম ইতিহাস লুকিয়ে আছে অধুনা বাংলাদেশের নাটোরে। সেখান থেকেই ভারতে এসেছিল এই মিষ্টি। কাঁচাগোল্লার সৃষ্টি নিয়ে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী আছে নাটোরে।
প্রায় আড়াইশো বছরের আগের কথা। নাটোরের লালবাজারের অবস্থিত প্রসিদ্ধ মধুসূদন পালের মিষ্টির দোকান। প্রতিদিন দেড় থেকে দু’মণ ছানার বিভিন্ন মিষ্টি তৈরি হত এই দোকানে। কিন্তু একদিন হঠাৎ দোকানের ১০/১৫ জন কারিগরের একজনও আসলো না। এর ফলে গভীর সমস্যার সম্মুখীন হয় মধুসূদন বাবু কারণ এত পরিমাণ ছানা তো ফেলে দেওয়া যায় না। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে, অগত্যা তিনি চিনির রসে ছানা ঢেলে জ্বাল দিয়ে রাখলেন। পরদিন ওই ছানা মুখে দিয়ে দেখা গেল অদ্ভুত স্বাদে ও গন্ধে ভরপুর এক নতুন মিষ্টি তৈরি হয়েছে। নতুন ধরণের এই মিষ্টি দেখে অবাক হয়ে গেল সকলেই। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সব মিষ্টি বিক্রিও হয়ে গেল। নতুন এই মিষ্টির নাম কি দেওয়া যায় ভাবা শুরু হল। চিনির রসে ছানার গোল্লা ফুটিয়ে রসগোল্লা তৈরি করা হয়। অতএব চিনির রসে কাঁচা ছানা জ্বাল দিয়ে যে মিষ্টি তৈরি হচ্ছে তার নাম রাখা হল ‘কাঁচাগোল্লা’।
বনলতা সেনই নয়, নাটোরের সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে কাঁচাগোল্লাও!
কথা সাহিত্যিক জাকির তালুকদার জানান, “নাটোরের পানি মূলত কাঁচাগোল্লা তৈরির জন্য আদর্শ। নাটোরের বিভিন্ন স্থানে অল্প স্রোতের অসংখ্য খাল ছিল। কাপড়ে বেঁধে দুধের তৈরি ছানা ওই সব খালের পানির ভেতর ডুবিয়ে রাখা হতো। সকালে তুলে সব পানি বের করে দেওয়া হতো। ওই ছানা থেকেই তৈরি হতো কাঁচাগোল্লা। এ কারণেই নাটোরের মতো সুস্বাদু কাঁচাগোল্লা আর কোথাও তৈরি হয় না।” ১৭৫৭ সাল থেকেই এই মিষ্টির ব্যাপক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। তারপর ধীরে ধীরে বিদেশেও কাঁচাগোল্লা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কাঁচাগোল্লা অন্যান্য মিস্টির থেকে পৃথক, তার মধ্যে থাকা কাঁচা ছানার একটা মিষ্টি গন্ধের কারণেই।
Discussion about this post