দেবী চৌধুরানী শুধুই উপন্যাসের চরিত্র? না, তিনি সত্যিই ছিলেন। ইংরেজ শাসকের ভাষ্যে তাঁকে ডাকাত বলা হলেও, তিনি আসলে ছিলেন নিজের অঞ্চলের মানুষের রক্ষাকর্ত্রী স্বরূপ। অবিভক্ত বাংলায় জলপাইগুড়ি নামের আলাদা জেলা গঠনের আগে, তিস্তা নদীর পশ্চিম পাড়টির নাম ছিল বৈকুণ্ঠপুর। ইংরেজ আমলে বৈকুণ্ঠপুর ছিল রংপুর কালেক্টরেটের অন্তর্গত। ১৮৮২ সালে ব্রিটিশ রাজের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এই অঞ্চলে এসেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসটি। সম্ভবত মানুষের মুখে দেবী চৌধুরানীর কথা শুনেই তিনি সাজিয়েছিলেন তাঁর উপন্যাসের চরিত্রকে। সেই দেবী চৌধুরানীর বাড়িটি আজ রংপুরের পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
ঐতিহাসিক এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উল্লিখিত ‘দেবী চৌধুরানী’ আসলে ছিলেন রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার জয়দুর্গা দেবী। শিবুকুণ্ঠিরাম গ্রামের মেয়ে তিনি। তাঁর বিয়ে হয়েছিল রংপুরের মন্থনা রাজবাড়িতে। মন্থনা এস্টেটের রাজা রাঘবেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৭৬৫ সালে মারা যান। তাঁরই স্ত্রী জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী তিন দশক ধরে এই রাজত্ব রক্ষা করেছিলেন। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের প্রিয় শাসক। ব্রিটিশরা রাণীর থেকে রাজত্ব নিয়ে নিলেও ধরে রাখতে পারেনি। শোনা যায় ভবানী পাঠকের সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং সন্ন্যাস বিদ্রোহেও অংশ নিয়েছিলেন দেবী চৌধুরানী। সেই দেবী চৌধুরানীরই প্রাসাদ আজ ভগ্নপ্রায় অবস্থায় টিকে আছে মানুষের দর্শনীয় স্থান হয়ে।
বঙ্কিমের উপন্যাসে দেবী চৌধুরানীর জীবন, তাঁর বীরত্ব এবং অধিকারের লড়াইয়ের কাহিনি আমরা পড়েছি। দেবী চৌধুরানীর নাম ছিল প্রফুল্ল। স্বামী চলে যাওয়ার পর প্রফুল্ল জীবনজুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পরিণত হয় বিপ্লবী ডাকাতে। যে ডাকাত গরীবের পাশে দাঁড়ায় এবং ধনীদের কাছ থেকে ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে গরীবদের মধ্যে বিতরণ করে। দেবী চৌধুরানী চরিত্রটি নারীর ক্ষমতায়ন এবং অধিকারের লড়াইয়ের এক অনুপ্রেরণামূলক চরিত্র হিসেবে মূল্যায়িত হয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। ফলে তাঁর প্রাসাদটিও সেই বীরত্বের ইতিহাসকেই বহন করে। বাড়িটি স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নকশা এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে ভগ্নপ্রায় প্রাসাদটি।
Discussion about this post