সময়টা ১৯৭১। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলায় টালমাটাল বাংলাদেশ। অসংখ্য মানুষ তখন ভারতে ছুটে আসছেন আশ্রয়ের সন্ধানে। এই অমানবিক অত্যাচার, হত্যালীলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাইছেন তখন অনেকেই। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলেই সেসব মানুষের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে। তাঁদের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের সংখ্যাই খুব স্বাভাবিকভাবে বেশি। কিন্তু আরও এক মানুষ ছিলেন, যিনি সুদূর ব্রিটেনের বাসিন্দা। সেখানে বসেই তাঁর ব্যক্তিমন এবং শিল্পীমন কেঁদে উঠেছিল মানুষের জন্য। আর তখনই ঈশ্বরের দূতের মত এসে দাঁড়িয়েছিলেন এই মানুষটি। তিনি জর্জ হ্যারিসন।
জর্জ হ্যারিসনের নাম উঠলেই সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে সরাসরি আসে ‘দ্য বিটলস’এর নাম। চার যুবক, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, ঢোলা প্যান্ট, হাতে গিটার, ড্রাম নিয়ে গেয়ে চলেছে গান, আর জগত মেতেছে তাদের সুরে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ তাঁদের ভালবেসেছে, সর্বত্র পেয়েছেন সম্মান। এই চার যুবকের মধ্যেই একজন জর্জ। তিনিও ওই ‘বয় ব্যান্ডে’ থাকলেও, পরবর্তীকালে তাঁর জীবনকে দেখার দৃষ্টি একটু যেন বদলে গিয়েছিল। তিনি ভারতে এসে অধ্যাত্মবাদ নিয়ে পড়াশোনা ও চর্চা করেন, আকৃষ্ট হন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি। শেখেন সেতার। তাঁর গুরু ছিলেন পন্ডিত রবিশঙ্কর।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় চুপ করে বসে থাকতে পারেননি রবিশঙ্কর। ত্রাণ সংগ্রহ এবং অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন তিনি অনুভব করেছিলেন। তখনই তিনি কথা বললেন ছাত্র জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। হ্যারিসনকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে দাতব্য সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। গুরু-শিষ্য দুইজনের মন যেন মিলে গেল। হ্যারিসন অকুণ্ঠ চিত্তে প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। তিনি তাঁর বন্ধুদেরও আমন্ত্রণ জানালেন ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের ওই অনুস্থানে যোগদানের জন্য। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হলো ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।
শুরুতেই পল্লিগীতির সুরে ‘বাংলা ধুন’ নামে একটি পরিবেশনা করেছিলেন রবিশঙ্কর। তারপরই মঞ্চে ওঠেন জর্জ হ্যারিসন। ৪০ হাজার মানুষের সামনে জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের জন্য গেয়েছিলেন গান। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এ ধরনের বড় অনুষ্ঠান ওটাই ছিল প্রথম। অনুষ্ঠানে সংগৃহীত দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য দেওয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিক সেই কনসার্টে গান গেয়েছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন এবং আরও অনেকে। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। গানটি লিখেছিলেন জর্জ হ্যারিসন এবং সুরও দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। গানের মূল কথাই ছিল বিশ্বের মানুষকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান।
Discussion about this post