১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে তখন ‘কালরাত্রি’। ‘অপারেশন সার্চলাইটে’ হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙালিকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বক্তব্য একটাই, ‘অপাকিস্তানি’ কার্যকলাপ করলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে তাদের। হত্যাকে তাঁরা এক প্রকার উৎসবের পর্যায়ে নিয়ে যায়। কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক বক্তব্যে জানান, পাকিস্তানের এই বিবাদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারতও। বিশ্ব রাজনীতির ময়দানেও তখন চলছে এক ঠান্ডা লড়াই। অবশেষে আগস্টে ভারত-রাশিয়া চুক্তি খানিক সাহস জোগাল ভারতকে।
৩ ডিসেম্বর, পাকিস্তান বায়ুসেনা ভারতের ১১ টি বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়। ব্যাস আর কী, যজ্ঞে ঘৃতাহুতি! ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হাত মিলিয়ে গড়ে তোলে ‘মিত্র বাহিনী’। একদিকে মিত্র বাহিনী অন্যদিকে বিপ্লবীদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। তারপর বাকিটা ইতিহাস। বেশিদিন টিকতে পারেনি পাকিস্তানি সেনা। ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথবাহিনীর কাছে। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় এক নতুন দেশ, বাংলাদেশ। সবুজ দিগন্তে লাল সূর্য, স্বাধীনতা পায় বাংলাদেশ।
তবে এই যুদ্ধের বেশ জোরালো প্রভাব পড়ে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেশ কয়টি ঘাঁটি গড়ে ওঠে তৎকালীন পশ্চিম দিনাজপুরের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায়। যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত হলে ঘাঁটিগুলিও এলাকা থেকে উঠতে থাকে একে একে। এই সময়ই ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধে ব্যবহৃত একটি ট্যাঙ্ক রেখে যায় বালুরঘাট শহরে। যা বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর শহর। সেই ট্যাঙ্কটির এখনও দেখা মিলবে শহরে ঢুকতেই রঘুনাথপুর এলাকায়। বর্তমানে সেই জায়গাটির নাম ‘ট্যাঙ্ক মোড়’। যুদ্ধের স্মারক হিসেবে এখনো সযত্নে রাখা আছে ট্যাঙ্কটিকে।
আরও পড়ুন ‘রাইখর’ শুধু মাছ নয়, আত্রেয়ী তথা দিনাজপুরের ঐতিহ্যও বটে!
এলাকার ষাট-সত্তোরোর্ধ্ব বাসিন্দাদের কাছে ‘৭১ এর যুদ্ধের স্মৃতি এখনো টাটকা। সেই সময় আকাশে যুদ্ধ বিমানের আওয়াজে যেন তারা হয়ে উঠেছিলেন এক প্রকার অভ্যস্ত। বাঙ্কারে সপরিবারে লুকিয়ে থাকা থেকে রাত্রে সেনাবাহিনীর টহলের শব্দ ,কোনওটাই তাদের কাছে আবছা নয়। সেই যুদ্ধের স্মৃতিকে আরো তীব্রভাবে উস্কে দেয় এই ট্যাঙ্ক। বারুদের গন্ধকে জাগাতে নয়। বরং বারুদের ভয়াবহতা কতটা মারাত্মক হতে পারে, সেই বিভীষিকাই শেষ পর্যন্ত মনে করিয়ে দিক এই ট্যাঙ্ক। তাহলে হয়তো ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ থেকে খানিক নিস্তার পাবে এই বিশ্ব!
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – বালুরঘাট টাউন
Discussion about this post