সংস্কৃতির পীঠস্থান আমাদের ভারতবর্ষ। ভারতের সংস্কৃতি প্রায় কয়েক সহস্রাব্দ-প্রাচীন বৈচিত্র্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও রীতিনীতিগুলির একটি সম্মিলিত রূপ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন নিদর্শন, যা আজও আমাদের সামনে জীবন্ত করে তোলে দেশের প্রাচীন ইতিহাসকে। ঠিক তেমনই সৃষ্টির ৫০০ বছর পার করে আজও ভারতের সুপ্রাচীন ইতিহাসের বোঝা বয়ে চলেছে থাঞ্জভুরের ঐতিহাসিক ‘সরস্বতী মহল লাইব্রেরি’।
থাঞ্জাভুর শহর তামিলনাড়ুর অন্তর্গত একটি প্রাচীন শহর। এই শহরের প্রাচীন স্হাপত্যগুলির মধ্যে অন্যতম ‘সরস্বতী মহল লাইব্রেরি’। ১৫৩৫ সাল থেকে ১৬৭৪ সাল পর্যন্ত এখান থেকেই শাসনকার্য চালাতেন ‘নায়ক’ রাজবংশের রাজারা। শুধু সামরিক দিক থেকেই নয়, নায়ক রাজাদের শাসনকালে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিল থাঞ্জাভুর। প্রাচীন সাহিত্য সংরক্ষণের জন্য তৈরি হয়েছিল বিশেষ এই লাইব্রেরি। যা তামিলনাড়ু তথা ভারতের প্রাচীনতম ‘জীবিত’ গ্রন্থাগার। নায়কদের শাসনকালের বহু আগে ভারতে একাধিক লাইব্রেরি নির্মিত হয়েছিল। তবে কালের আবহে সেসব হারিয়ে গেলেও আজও নিজের স্বত্বা ধরে রেখেছে ‘সরস্বতী মহল লাইব্রেরি’। ‘সরস্বতী মহল লাইব্রেরি’ স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘মহারাজা সেরফোজির লাইব্রেরি’ হিসাবেও। মজার বিষয় হলো ‘সেরফোজি’ নায়ক রাজবংশের কোনো শাসক নন। তিনি ছিলেন মারাঠা। তবে লাইব্রেরির এই নামকরণের পেছনে রয়েছে এক প্রাচীন ইতিহাস।
১৬৭৫ সালে মারাঠা সম্রাট থাঞ্জাভুর আক্রমণ করলে,তাতে পরাজয় স্বীকার করেন ‘নায়করা’। তখন ‘নায়ক’ বংশের তৈরী এই লাইব্রেরিকে সাজিয়ে তুলতে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন মারাঠা মহারাজ সেরফোজি দ্বিতীয়। সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। থাঞ্জাভুর লাইব্রেরিতে যে-সকল প্রাচীন গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল, সেসব কিছু দিনের মধ্যেই পড়ে ফেলেন সেরফোজি। তারপর বই-খিদে মেটাতে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে সংস্কৃত পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানান তিনি। বহু প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের অনুলিপিও তৈরি করিয়েছিলেন সেরফোজি। সংস্কৃত ছাড়াও ছিল তামিল, তেলেগু মারাঠি ও ইংরাজি গ্রন্থও। এই লাইব্রেরিতে পাণ্ডুলিপির মোট সংখ্যা প্রায় ৪৯ হাজার। যার মধ্যে রয়েছে শুধু ৩৯ হাজার সংস্কৃত গ্রন্থ, সাড়ে ৩ হাজার তামিল এবং ৩ হাজার মারাঠা সাহিত্যের দুর্মূল্য গ্রন্থও রয়েছে এই গ্রন্থাগারে।
অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ শাসনকালে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই লাইব্রেরির দরজা। তবে তা পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে এই গ্রন্থাগার জনসাধারণের জন্য খুলে দেয় ব্রিটিশ শাসকরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই গ্রন্থাগার তো বটেই, সমগ্র মারাঠা প্যালেসের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় ভারত সরকার। এই প্রাচীন লাইব্রেরী শুধু তামিলনাড়ুই নয়, গোটা দেশেরই এক গর্বের জায়গা।
Discussion about this post