নাবিকের হাতে বদলে যাওয়া ‘সাহেবি তেলেভাজা’ বা ডোনাটের গল্প শুরু হয় বিশ্বায়নের ঢেউয়ে বাঙালির খাদ্যতালিকায় সাহেবি খাবারের প্রবেশের সঙ্গেই। আজ কেক, কাটলেট বা পিৎজা যেমন সহজলভ্য, তেমনই ডোনাটও শহুরে বাঙালির কাছে এক পরিচিত নাম। বিশেষত ছোটদের কাছে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। কিন্তু জন্মলগ্নে ডোনাট ছিল একেবারেই ভিন্ন। মিষ্টি নয়, বরং মাংস দিয়েই তৈরি হত এবং এর আইকনিক মাঝের গর্তটিও ছিল না। ডাচদের ‘ওলিকোয়েক’ নামের তেলেভাজা, যা মাংস ও ময়দার মিশ্রণ শূকরের চর্বিতে ভেজে বানানো হত। এটি উনিশ শতকের শুরুতে ডাচ বসতির মাধ্যমে পৌঁছে যায় মার্কিন কুশিনে। সেখানে তা ‘ওয়েল কেক’ বা ‘ডো-নাট’ নামে পরিচিতি পায়। দেখতে ছিল বলের মতো। কিন্তু এর ফলে একটি বড় সমস্যা দেখা দিত, বাইরে সেদ্ধ হলেও ভেতরের পুর প্রায়ই কাঁচা থেকে যেত। এই সমস্যার সমাধানেই সামনে আসেন এক তরুণ মার্কিন নাবিক, হ্যানসন গ্রেগরি।
১৮৩২ সালে মেইনে জন্ম নেওয়া গ্রেগরি মাত্র ১২ বছর বয়সে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন এবং ১৫ বছরেই বিশ্বের কনিষ্ঠতম ক্যাপ্টেন হয়ে ওঠেন। তাঁর সাহসিকতার জন্য স্পেনের রানি দ্বিতীয় ইসাবেলার কাছ থেকেও সম্মাননা পান। কিন্তু তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল তাঁর নাবিকদের স্বাস্থ্য। সমুদ্রে টানা যাত্রায় তারা প্রায়ই পেটের অসুখে ভুগতেন, যার অন্যতম কারণ ছিল টিফিন হিসেবে পরিবেশিত ডোনাটের ভেতরের কাঁচা পুর। এর সমাধানের খোঁজে গ্রেগরি নানা আকারে পরীক্ষা চালান। কখনও তাকে চ্যাপ্টা কাটলেটের মতো, কখনও সসেজের মতো লম্বা আকার দেন, কিন্তু ফল মেলেনি। অবশেষে তিনি ১৮৪৭ সালের ২২ জুন এক অভিনব কৌশল প্রয়োগ করেন। তিনি ডোনাটের মাঝখানটি বোতলের ঢাকনা দিয়ে ফাঁপা করে দেন। এতে তেল ও মশলা সমানভাবে পৌঁছে ভেতরটাও সেদ্ধ হতে থাকে। সেই দিন নিজের হাতে বানানো এই নতুন আকারের ডোনাট নাবিকদের খাওয়ান গ্রেগরি এবং পরে বাড়ি ফিরে মাকেও শেখান। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁদের পারিবারিক ডোনাট ব্যবসা, যা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মেইনে।

গ্রেগরি পরে সস্ত্রীক ম্যাসাচুসেটের সেইলর’স স্নাগ হারবারে চলে আসেন এবং মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বিদায় জানান সমুদ্রজীবনকে। তিনি কয়লা খনিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করলেও ডোনাটের ব্যবসা চালিয়ে যান। ১৯১৬ সালে ‘প্যাট্রিয়ট লেজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের আবিষ্কারের গল্প জানান। কিন্তু এখানেই শুরু হয় বিতর্ক। অনেকেই দাবি করেন, ডোনাটের আসল আবিষ্কারক তারা। ১৯৪১ সালের নভেম্বর, পার্ল হারবার আক্রমণের আগে নিউ ইয়র্ক আদালতে হয় ডোনাট-মামলার শুনানি। খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব এবং বহু সাধারণ মানুষ গ্রেগরির পক্ষে দাঁড়ান। যদিও তখন গ্রেগরি প্রয়াত, তাঁর ভাইপো ফ্রেড ক্রকেট মামলা লড়েন। আদালত আনুষ্ঠানিক পেটেন্ট ছাড়াই গ্রেগরিকেই ডোনাটের আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

১৯৪৭ সালে ডোনাট আবিষ্কারের শতবর্ষে যুক্তরাষ্ট্র ২২ জুনকে ‘ন্যাশনাল ডোনাট ডে’ ঘোষণা করে। ক্যামডেনের স্নাগ হারবারে সমুদ্রের দিকে মুখ করা তাঁর একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি স্থাপন করা হয়, যা আজও দাঁড়িয়ে আছে। সেই শহরে প্রতি বছর আয়োজিত হয় ডোনাট উৎসব, যেখানে ভিড় জমান দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা। মজার এই খাবারের আড়ালে লুকিয়ে আছে সাহসী এক নাবিকের বুদ্ধিমত্তা, দীর্ঘ বিতর্ক আর সমুদ্রযাত্রার স্মৃতি, যা না জানলে হয়তো ডোনাটকে আমরা কেবলই এক আধুনিক ফাস্টফুড বলেই মনে করতাম।
Discussion about this post