বেশ কিছুদিন ধরেই বাগনানের বাঁটুল গ্রাম খবরের শিরোনামে উঠে আসছে। অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে শুরু করে কিছু জনপ্রিয় সংবাদপত্র পর্যন্ত এই বাঁটুল গ্রামের একটি পুকুরের মাহাত্ম্য প্রচার করে চলেছে, তার নাম ‘মোটা পুকুর’। সেই পুকুরে ডুব দিয়ে চালের পুঁটুলি ভাসালে পুঁটুলির চাল ফুলে ওঠে এবং চাল ফুলে উঠলে নাকি মানুষও মোটা হয়ে যায়। এমন উদ্ভট বুজরুকি এখনও নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এমন বুজরুকিকে কিছু সংবাদপত্র যে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে এটাই হাস্যকর ব্যাপার।
এই ‘মোটা পুকুর’ নিয়ে এতো রমরমা চলায় ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির বাগনান শাখা বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেন। দু’দিন ধরে খোঁজ তল্লাশ চালানোর পর এই পুকুর, এই পুকুরের মালিকানা ও পাশের চন্ডীমন্দির সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানা যায়। এই পুকুরের মালিক হলেন অরুন সরকার নামে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। তিনি বেলুড়ের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং বেলুড়েই স্থায়ীভাবে বাস করেন। এই পুকুরটির মাহাত্ম্য ১০০ বছরের বেশি বলে দাবী করা হলেও সে কথা সত্যি নয়। কারন অরুণ বাবু এই পুকুর কেনার পরে এখানে চন্ডীমন্দির হয়, পুজো-আচ্চা শুরু হয়।
সুতরাং খুব বেশি হলে পুকুর এবং পুকুর ঘিরে এই তথাকথিত অলৌকিক কান্ডকারখানার বয়স ৪০ বছরের বেশি নয়। শোনা যায় আগে এই পুকুরের চারপাশে বনজঙ্গল ছিলো এবং পুকুরটিও পদ্মবনে ভরে ছিল। সবটাই অবশ্য সবার শোনা কথা। পুকুরে একটি পাথর পাওয়া গেলে সেটাই দেবী চন্ডী বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্থানীয় এক ব্যক্তি উপেন মান্না এই মন্দিরকে ঘিরে তাবিচ-কবচ দেওয়ার কাজ শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে বিশ্বনাথ মান্না এবং আরতি ক্যুইলা এই সাপ্তাহিক ‘ডাক্তারি’ চালু করেন। তাদের দাবী এই পুকুরে স্নান করলে রিকেট রোগ, মেয়েদের গুপ্ত রোগ সহ নানা রোগ নাকি সেরে যায়।
স্থানীয়রা বলেন শনিবার চন্ডীমন্দিরে পুজো হয় এবং রবিবার ভক্তরা পুকুরপাড়ের পাকুড় গাছে হলুদ, সিঁদুর মাখায় এবং পুকুরে স্নান করে। তারপরে লাউ, কুমড়ো, নুনের বস্তা দিয়ে পুজো দেয়। এ ঘটনা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। কিন্তু ডুব দিলে মোটা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা নতুন সংযোজন। জানা যায় রোগ সেরে যাওয়ার পরে নাকি মন্দিরে বড় করে পুজো দিতে হয় এবং যারা এই তাবিচ-কবচের ডাক্তারির সঙ্গে যুক্ত তাদের পারিশ্রমিকও দিতে হয়। এখানে পুজো দিয়ে অনেক রিকেট রোগীই নাকি সুস্থ হয়ে গেছে এমনটাই দাবী করেছেন এই ‘মোটা পুকুর’ কান্ডের মূল কান্ডারি আরতি ক্যুইলা। এমনকি সেসব ভক্তদের সাথে তাঁর যোগাযোগ আছে বলেও জানান। কিন্তু যখন কারা কারা সুস্থ হয়েছে তার প্রমাণ চাওয়া হয় তখন তা দিতে পারেননি। মজার বিষয় হল অরুন সরকারের এক ভাই তরুন সরকার এখন এই পুকুরের দায়িত্বে আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাঁর বাত-বেদনার সমস্যা আছে এবং তিনি এই পুকুরেই রোজ স্নান করেন। তাতেও তার ব্যথা ভালো হয়নি। অবশ্য তাঁরা এটাকে রোগের পর্যায়ে ধরেন না!
মোদ্দা কথা এই তাবিচ-কবচের বুজরুকির ব্যবসা বাড়ানোরই একটা নতুন কৌশল ‘মোটা পুকুর’ বলে প্রচার করা। অন্তত খোঁজখবর নিয়ে কারন হিসাবে তেমনটাই মনে হয়। আশ্চর্যের বিষয় যেখানে মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা, সে বিষয়ে সচেতন করাই সংবাদমাধ্যমের কাজ। সেখানে বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যম এই নিয়ে রসালো খবর করে প্রকারান্তরে কুসংস্কারকেই মান্যতা দিচ্ছে, এটাই দুঃখের বিষয়।
তথ্যসূত্র – ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির তরফে ভাস্কর রায়
Discussion about this post