দুর্গা পুজো এলেই পাড়া জেগে ওঠে আলোর রোশনাইয়ে, ঢাকের তালে, আর মানুষের ঢল নামে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। কিন্তু ভিড় আর কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে যদি একটু প্রকৃতির কোলে, সবুজ পাহাড়ে মিশে গিয়ে পুজোর ছুটি কাটানো যায়, তবে কেমন হয়? কিন্তু বাঙালির সারাবছর বেড়াতে যাওয়ার তালিকায় রয়েছে সেই একঘেয়ে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো দীঘা, মন্দারমনি, দার্জিলিং, ডুয়ার্স। তবে এই সব জায়গায় যাওয়ার জন্য এখন থেকেই ট্রেনের টিকিট পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। তাই এবারে একঘেয়ে সমুদ্র কিংবা পাহাড় নয়, বরং পুজোর ছুটিতে ঘুরে আসুন ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচি এবং তার আশেপাশের দুটি মনকাড়া জায়গা নেতারহাট ও পাত্রাতু। প্রকৃতি, সংস্কৃতি আর নির্জনতা – সব মিলিয়ে এই ট্রায়ো-ট্রিপ হতে পারে আপনার পুজোর সেরা উপহার।

রাঁচি, এক সময়ের বিহারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী, আজ তা ঝাড়খণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। শহর হলেও এখানে প্রকৃতির ছোঁয়া একেবারে অনুভবযোগ্য। এই শহরের বিভিন্ন কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে জলপ্রপাত, পাহাড় আর ঘন সবুজ বনভূমি। হুড্রু ফলস, দশম ফলস বা জোনহা ফলস – প্রতিটিই যেন প্রকৃতির শিল্পকর্ম। পুজোর সময় এই ঝরনাগুলি হয়ে ওঠে আরও মোহময়, বর্ষা পেরিয়ে জলধারার প্রবাহ থাকে টইটম্বুর। এখানকার পুজোও উপেক্ষা করার নয়, বিখ্যাত বাকরি বাজার, হরমু রোড, কঙ্করটোলা অঞ্চলের দুর্গা পুজোগুলি স্থানীয়দের কাছে বিশেষ আকর্ষণ।

রাঁচি থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে নেতারহাট যেন এক টুকরো খাঁটি সৌন্দর্য। ছোটনাগপুর মালভূমির কোলে অবস্থিত এই জায়গাটিকে অনেকে ‘ঝাড়খণ্ডের কাশ্মীর’ বলেও থাকেন। এখানকার সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয় মন ছুঁয়ে যায়। অক্টোবর মাসে আবহাওয়া থাকে একদম আরামদায়ক, সকাল-সন্ধ্যায় পড়ে হালকা কুয়াশার চাদর। পাইন গাছের জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ি পথ, একদম সিনেমার মতো অনুভব দেয়। নেতারহাটের সৌন্দর্য্য যত না মুখে বলা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি হৃদয়ে অনুভব করা যায়। পুজোর সময় এখানে তেমন ভিড়ও হয় না, ফলে প্রকৃতির সঙ্গে নিরিবিলি সময় কাটানোর সুযোগ মেলে। এখানে দুর্গা পুজো তেমন জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও স্থানীয় আদিবাসীদের পুজোর ছাপ মেলে, যা একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতা দিতে বাধ্য।

নেতারহাট থেকে ফেরার পথে বা রাঁচি থেকে খুব কাছে অবস্থিত পাত্রাতু ভ্যালি যেন এক ঝলক ইউরোপের পাহাড়ি শহরের মতোই। এখানকার পাত্রাতু ড্যাম, তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি রাস্তাগুলো, আর মনোরম ভিউপয়েন্ট আপনাকে বারবার থামতে বাধ্য করবে। হালকা কুয়াশা, মেঘে ঢাকা উপত্যকা আর মাঝে মাঝে রোদ্দুরের ঝলকানি – সব মিলিয়ে পাত্রাতু হয়ে ওঠে এক স্বপ্নময় জায়গা। পুজোর সময়ে পাত্রাতু ভ্যালিতে সূর্যাস্ত এক আলাদা মাত্রা এনে দেয়। হাতে যদি সময় থাকে তাহলে ঘুরে নিতে পারেন টেগোর হিল, পালানি ফলস। এখানকার স্থানীয় পুজোগুলি বেশ ছিমছাম ও শান্তিপূর্ণ, ভিড় কম, ফলে মন দিয়ে মণ্ডপ দেখা যায়। যারা একটু অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য রয়েছে পাত্রাতু ভ্যালিতে হাইকিং ও বাইকিংয়ের সুযোগ।

কলকাতা থেকে রাঁচি যেতে পারেন ট্রেনে বা বিমানে। হাওড়া থেকে রাঁচিগামী একাধিক ট্রেন রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম শতাব্দী এক্সপ্রেস। সময় লাগে ৭-৮ ঘণ্টার মতো। বিমানে অবশ্য সেই সময় গিয়ে দাঁড়ায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। রাঁচি থেকে নেতারহাট এবং পাত্রাতু যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করাই সবচেয়ে ভালো। রাঁচিতে থাকার জন্য রয়েছে বিভিন্ন বাজেটের হোমস্টে ও হোটেল। আপনি আপনার বাজেট অনুযায়ী থাকার বন্দোবস্ত করতে পারেন। নেতারহাটে সরকারি ট্যুরিস্ট লজ, ফরেস্ট বাংলো এবং কিছু বেসরকারি হোটেল পাওয়া যায়। পাত্রাতুতেও কিছু সুন্দর রিসর্ট গড়ে উঠেছে, যেখানে আপনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন একান্তে কাটাতে পারবেন। পুজোর ভিড় এড়িয়ে, মণ্ডপ হপিং নয়, বরং মেঘ, পাহাড়, ঝরনা আর একটু নীরব প্রকৃতির সান্নিধ্যে কটা দিন কাটাতে চান? তাহলে রাঁচি, নেতারহাট আর পাত্রাতুর এই ট্রিপ হতে পারে আপনার পুজোর ছুটির পারফেক্ট পরিকল্পনা।
চিত্র ঋণ – Izifiso-এর ফেসবুক পেজ, সঙ্গীতা পরাল, ভ্রমণ পিপাসুর ফেসবুক পেজ, শিবাশিস জানা
Discussion about this post