১৪২ বছরের কালের সাক্ষী এই ঐতিহাসিক রেলপথ। কলকাতার শিয়ালদহ রেল-স্টেশন থেকে পূর্ব বঙ্গ রেলওয়ে ও আসাম রেলওয়ের একমাত্র সংযোগস্থল এই রেলপথের প্রতিটি স্লিপার। ১৯৬৫ সালের আগে দার্জিলিং মেল শিয়ালদা-রানাঘাট-কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা- পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, পাবনার ঈশ্বরদি- শান্তাহার-হিলি -দিনাজপুরের পার্বতীপুর-নীলফামারী-চিলাহাটি -স্টেশন ধরে হলদিবাড়ী-জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি হয়ে পৌঁছত দার্জিলিং। স্বল্প সময়ে আসাম,শিলং, মণিপুর সর্বত্রই যাওয়া যেত এই রেলপথ দিয়ে। এই রেলপথেই ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মোট চার বার দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ডায়বেটিস ও নানান শারীরিক ব্যাধিতে আক্রান্ত স্বামী বিবেকানন্দ ডাক্তারের পরামর্শে বায়ু পরিবর্তনের আশায় দার্জিলিং মেল চাপেন। ১৮৯৭ সালে কিছু দিন কাটাতে এসেছিলেন দার্জিলিংয়ে বর্ধমান রাজবাড়ীর চন্দ্রকুঠিরে। স্বামীজির বেশ কিছু লেখায় দার্জিলিং এবং এই রেলপথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উদার বর্ণনা পাওয়া যায়।
সুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী,দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, বাঘাযতীনের আসা যাওয়ার মাঝে অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার রাজসাক্ষী এই রেলস্টেশনগুলো। ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর নিয়ে দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বলি হল এই জীবন-রেখা। দার্জিলিং মেলের এই দীর্ঘ এই রেলপথ উপড়ে ফেলা হল। দুই বাংলার মেলবন্ধন আর ভ্রাতৃত্বকে গলা টিপে হত্যা করলো তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। তবে নতুন প্রজন্মের জন্য সুখবর! সুদীর্ঘ ৫৫ বছর পর ফের চালু হচ্ছে বাঙালীর আবেগ মেশানো এই রেলপথ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় চিলাহাটি রেলস্টেশন থেকে ভারতের নবনির্মিত আন্তর্জাতিক মানের হলদিবাড়ি রেলস্টেশনের দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমিটার। পরিত্যক্ত এই ৭ কিলোমিটার রেলপথে ফিরে এসেছে রেলের কর্মচঞ্চলতা। বসছে নতুন ভাবে রেলপথ, খুঁটি, স্লিপার, পাথর। করোনা পরিস্থিতি না থাকলে চলতি বছরের ৩০ জুন এ পথেই কলকাতার শিয়ালদহ রেলস্টেশন থেকে বাংলাদেশ হয়ে কোচবিহার-শিলিগুড়ি যাওয়ার দার্জিলিং মেলের হুইসেল বেজে উঠত। আশা করা হচ্ছে করোনা সঙ্কট দূরে হলেই রেলপথের বাকি আনুষ্ঠানিকতার কাজ শেষ হবে।
বাংলাদেশের চিলাহাটি সীমান্তে দাঁড়ালে ভারতের হলদিবাড়ি রেলস্টেশনের লাল-সবুজ-হলুদ সিগনাল বাতিগুলো’র উজ্জ্বলতা কাঁটাতার ভেদ করে জানান দিচ্ছে এক বার্তা। বাংলাদেশ ও ভারতের নতুন তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে এই ঐতিহাসিক রেলপথ ফের আলোকিত করবে দুই বাংলার ভবিষ্যৎ। সমৃদ্ধ করবে শিল্প-সংস্কৃতি এবং হারানো ঐতিহ্যকে। দুই বাংলার সবুজ প্রকৃতির মাঝে আবারও ধ্বনিত হবে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গান, “বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।।বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ” এই রেলপথে রচিত হবে পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলার সম্ভবনা আর সম্প্রীতির গল্প। আরও একবার সম্প্রীতির হাতে শেষ হবে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের অশুভ প্রেতাত্মা।
Discussion about this post