হরগৌরী হোক কিংবা সাধারণ ঝাল-ঝোল, যেকোনো রান্নাতেই অনায়াসে বাজিমাত করতে পারে রাইখর। উত্তরবঙ্গের তিস্তা-তোর্সার মতই একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী হল আত্রেয়ী। আর আত্রেয়ী ও রাইখর যেন একে অপরের সমার্থক। আঞ্চলিক ভাষায় মাছটি অবশ্য ‘রাইখ’ অথবা ‘আইখর’ নামেও পরিচিত। না না, একে আবার ফ্যাসিস্ট হিটলারের ‘থার্ড ‘রাইখ’-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। আপাদমস্তক এই দুই ‘রাইখ’ এর মাঝে কোন মিল নেই। বালুরঘাটে এসেছে অথচ আত্রেয়ীর রাইখর খায়নি এমন লোকের সংখ্যা খুব কম। বাড়ির অতিথির পাতে এই মাছের পদ আবশ্যিক। আকারে ছোট ,রুপোলি রঙের এই মাছটির কদর বোঝা যায় এলাকার প্রবাসীদের কাছে। মাছটি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি একে রান্নার উপযোগী করে তোলা ততটাই নির্ঝঞ্ঝাট। ভারী মিষ্টি স্বাদের রাইখরের গুণগান শুধুমাত্র সাধারণের হেঁশেলেই আটকে নেই, কখনো সে মা দুর্গার ও ভোগের প্রসাদ। বালুরঘাটের ঐতিহ্যবাহী পাল বাড়ির দুর্গাপুজোয় দশমীর বিশেষ ভোগ হিসেবে মা’কে পান্তা ভাতের সাথে রাইখর মাছ ভাজা নিবেদনের প্রচলন এখনো আছে।
আগস্টের শেষ থেকে বাজারে শুরু হয় রাইখরের আনাগোনা। আকারের সাথে সাথে বাড়তে থাকে মাছের দাম ও।সর্বোচ্চ দাম হয় পাঁচশো টাকা প্রতি কিলো। তবে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজারে এই মাছের যাতায়াত। তখন দাম ও কমে দাঁড়ায়, তিনশো টাকা প্রতি কিলোতে। বর্ষাকালে নদীতে উজানের সাথে এই মাছ সাঁতরে আসে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। আর তখনই মৎস্যজীবীদের জালে ধরা পড়ে যান মাছ বাবাজি। এক কালে আত্রেয়ীতে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা মিলত রাইখরের। আর সেখান থেকেই দূর-দূরান্তে বেরিয়ে পড়তো রপ্তানির জন্য। কিন্তু সময় ও পরিস্থিতি দুইই বদলেছে।এক কালে যে মাছ মৎস্যজীবীদের লক্ষ্মী লাভের অন্যতম উপায় ছিল, এখন শুধুমাত্র সেই মাছের উপর ব্যবসা নির্ভরশীল হলে দৈনিক উপার্জন ও সবিশেষ হবেনা। এপার বাংলায় আত্রেয়ী আজ প্রায় মজতে বসেছে। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে নদীর রাইখর। ইদানিং ,জেলার খাসপুর, দুর্লবপুর এলাকায় পুকুরে এ মাছের চাষ শুরু হয়েছে। তবে তার স্বাদ নদীর রাইখরের সাথে পাল্লায় পেরে উঠতে পারেনা।
মৎস্যজীবী সহ এলাকাবাসীদের অধিকাংশেরই অভিযোগ আত্রেয়ী দক্ষিণ দিনাজপুরে প্রবেশ করার আগে বাংলাদেশে একাধিক বাঁধ দেওয়ার দরুণ নদী তার পুরনো রূপ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বছরে বর্ষা বাদে বেশিরভাগ সময়ই নদী প্রায় শীর্ণ। যার জন্য নদীতে রাইখরের আনাগোনাও আগের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছে। মৎস্যজীবীরা কাঠা পদ্ধতিতে মাছ ধরার চেষ্টা করলেও, তাদের জালে এ মাছের দেখা পাওয়া মুশকিল । শুধু বাঁধগত সমস্যাই নয়, নানাবিধ কারণে নদীর একাংশ আজ দূষণের কবলে। এইসব নানাবিধ কারণ হয়ে উঠেছে নদীতে মাছের আনাগোনার অন্তরায়। তাই শুধু মৎস্যজীবীই নয়, এলাকার ভোজনরসিকদের কাছেও এখন যেন পুকুরের রাইখরই ভরসা। তবে প্রশাসন, অবৈজ্ঞানিক উপায়ে নদীতে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং নদীতে দূষণের মাত্রা কমানোর উদ্দেশ্যে অনেক সরকারি কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। ফলতঃ মৎস্যজীবী তথা এলাকাবাসীরা কিছুটা আশার আলো দেখছেন। তাদের ভরসা এভাবেই রাইখরের আনাগোনা বাড়তে থাকবে। হয়তো পরিবেশ সচেতনতাই ফিরিয়ে দিতে পারবে আত্রেয়ীর অতীতের গৌরব!
চিত্র ঋণ – মহম্মদ এ এম সোহাগ, তুলিকা মহন্ত, কাবেরী ঘোষ, বিজু
Discussion about this post