বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অনেকখানিই বহন করে পুরান ঢাকা। শহরের প্রতিটি পরতে রয়েছে তার চিহ্ন। স্থাপত্য, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে খাবারেরও রয়েছে আলাদা গুরুত্ব, আলাদা চাহিদা। এই জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে গেছে দেশের বাইরেও। পুরান ঢাকার পাড়া-মহল্লাগুলিতে ছড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী খাবারের বিশাল সম্ভার। বিরিয়ানি, কাবুলি, খিচুড়ি, হালিম, বাকরখানি, রুটি, কাবাব, শরবত ইত্যাদি খেতে মানুষ এখনো যান পুরান ঢাকায়। রোজার মাসে ইফতারে ঢাকার মানুষের পছন্দের তালিকায় প্রথম সারিতে থাকে এসব খাবার।
ঢাকার রান্নার পদ্ধতি অধিকাংশই মুঘল কায়দার। কালের বিবর্তনে তোররাবন্দি, শবডেগ, মোরগ মোসাল্লাম, খাগিনা, নার্গিস কোফতা, হারিরা, মাকুতি, মুতানজান, শিরমাল, গাওজাবান রুটি, গাওদিদা রুটি এসব খাবার হারিয়ে গেলেও, কিছু টিকে রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে। প্রায় ৪০০ বছর থেকে বাংলায় রাজত্ব করে আসছে স্বাদ, গন্ধ, মানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী পুরান ঢাকার কাচ্চি, তেহারি ও বিরিয়ানি। ‘নান্না মিয়ার বিরিয়ানি’র দোকান সেই কথাই বলে। দোকানের প্রতিষ্ঠাতা হাজী নান্না মিয়া পুরনো ঢাকার বাসিন্দা। ১৯৬২-৬৩ সালে তিনি বিরিয়ানির ব্যবসা শুরু করেন। ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের হাতেই রান্না করতেন নান্না মিয়া। ২০০৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। এখন যেসব বাবুর্চি রাঁধেন, তাঁদের প্রত্যেকেই নান্না মিয়ার কাছ থেকেই রান্না শিখেছেন।
বাবাকে সাহায্য করতে শৈশবেই সংসারের হাল ধরেছিলেন নান্না মিয়া। প্রথমে তিনি পাতার বিড়ি বানাতেন, পরে একটি খাবারের দোকানে কাজ নেন। সেই সময়েই নান্না তখনকার ঢাকার বিখ্যাত পেয়ারা বাবুর্চির অধীনে রান্না শেখা শুরু করেন। এরপর তিনি বাবুর্চির কাজ শুরু করেন। ষাটের দশকে বুড়িগঙ্গা থেকে সামনের মৌলভীবাজারে, জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন বিভিন্ন মানুষের আনাগোনা চলত। তাঁদের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণির মানুষদের একবেলা খাওয়ানোর জন্য মাদুর বিছিয়ে মোরগ পোলাও বিক্রি শুরু করেছিলেন নান্না মিয়া। সেই সময় মাত্র দেড় টাকায় এক প্লেট পোলাও এবং আস্ত একটা মুরগিসহ শাহি পোলাও উপভোগ করেছে মানুষ।
নান্নার মোরগ পোলাও ভোজনরসিকদের খুব প্রিয়৷ বর্তমানে দোকানে মাদুরের বদলে এসেছে চেয়ার টেবিল। মোরগ পোলাওয়ের পাশাপাশি পাওয়া যাচ্ছে খাসির কাচ্চি-বিরিয়ানি-রেজালা, ফিন্নি টিকিয়া ও বোরহানি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অর্ডার নিয়েও কাজ হয়। খাবারের মান ও চাহিদা বজায় রাখার জন্য ব্যবহার হয় দেশি মোরগ, চিনি, পোলাও চাল, মশলা সমস্ত দেশি জিনিস। এখানে সপ্তাহে একটি বিশেষ দিনে পোলাওয়ের সঙ্গে থাকে আস্ত মুরগি। ঢাকায় নান্না বিরিয়ানির ৭টি শাখা রয়েছে। পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ি, লালবাগ, নাজিরাবাজার, নাজিমউদ্দিন রোড, মিরপুর ও বেনারসি পল্লিতে শাখাগুলি অবস্থিত। নান্না মিয়ার বিরিয়ানির টানে গুলশান, ধানমন্ডি, বারিধারা, উত্তরা এবং ক্যান্টনমেন্টসহ অন্যান্য দূরবর্তী এলাকা থেকে রোজ আসেন অসংখ্য মানুষ।
Discussion about this post