মিশ্র সংস্কৃতির দেশ ভারতবর্ষ। ভারতের প্রতিটি অঞ্চলের ভাষা, ধর্মবিশ্বাস, নৃত্যকলা, সংগীত, খাদ্যাভ্যাস ও পোষাকপরিচ্ছদ এক এক ধরণের। তা সত্ত্বেও এক নিবিড় একাত্মতা লক্ষ করা যায় সকলের মধ্যে। ভারতের সংস্কৃতি কয়েক সহস্রাব্দ-প্রাচীন এই সব বৈচিত্র্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও রীতিনীতিগুলির সম্মিলিত রূপ। কিন্তু আধুনিকতার ভিড়ে আমাদের জীবন থেকে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন বিভিন্ন ঐতিহ্যগুলি। কথায় বলে, যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে, তাদের সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ একদমই থাকে না। কিন্তু প্রচলিত এই চিন্তা ধারা যেন মিথ্যে হয়ে গেল প্রাণীবিদ্যার প্রভাষক রজত কুমার পাণিগ্রাহীর হাত ধরে।
রজত কুমার পাণিগ্রাহী ওড়িশার বালাঙ্গিরে যুবোদয় কলেজের এক অধ্যাপক। সাহিত্য কিংবা ইতিহাসের অধ্যাপক না হয়েও রজতের নেশা প্রাচীন হারিয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি সংরক্ষণ। বিগত পাঁচ বছর ধরে ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ঘুরে ঘুরে আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং লোকশিল্পের তথ্য সংগ্রহ করে চলেছেন তিনি। হারিয়ে যেতে বসা বিভিন্ন লোকশিল্প এবং সংশ্লিষ্ট নেটিভ বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষণ তার একমাত্র উদ্দেশ্য। তার এই লড়াই ওড়িশার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক গভীর ছাপ ফেলছে।
বিজ্ঞানের অধ্যাপকের এরূপ সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণের পেছনে রয়েছে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কাহিনী। প্রায় বছর দশেক আগে পশ্চিম ওড়িশার এক প্রত্যন্ত গ্রাম রাজকন্যায় বেড়াতে গিয়েছিলেন রজত। সেখানে এক অদ্ভুত লোক অনুষ্ঠানের সাক্ষী হন তিনি। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ‘ছত্রযাত্রা’। উৎসবের বেশ কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন রজত, কিন্তু সময়াভাবে এই উৎসবের ইতিবৃত্তান্ত জানা হয়নি কিছুই। পরবর্তীতে ওড়িশায় ফিরে একাধিক লোকসঙ্গীত বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেও এই উৎসব বা শিল্পের সেভাবে কোনো হদিশ পাননি তিনি। এই ঘটনাই যেন বদলে দেয় রজতের চিন্তা ভাবনা। রজত বুঝতে পারেন, ওড়িশার বিভিন্ন গ্রামগুলি জীবনের মূলস্রোত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ফলে ছোট্ট গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থেকে গেছে সেখানকার লোকশিল্প। প্রাচীন এই লোকশিল্প গুলি রক্ষায় ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর লড়াই। পাশে পান ভাই সত্য পাণিগ্রাহী ও বন্ধু গণেশ প্রধানকে। এরপর থেকে ওড়িশার প্রান্তিক গ্রামগুলিতে মাঝে মধ্যেই পৌছে যেতেন এই তিনজন। ক্যামেরায় রেকর্ড করে আনতেন সেখানকার লোক উৎসবগুলি।
বিগত পাঁচ বছরে প্রায় হাজারেরও বেশি গ্রামে অভিযান চালিয়েছেন রজত ও তাঁর সহযোদ্ধারা। উৎসব গুলির পাশাপাশি লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্য এবং হস্তশিল্প সংক্রান্ত তথ্য গুলি সংগ্রহ করতেন তাঁরা। প্রান্তিক লোকশিল্পীদের থেকে নেটিভ বাদ্যযন্ত্রও সংগ্রহ করে থাকেন রজত। এরপর সাধারণ মানুষের কাছে এইসকল শিল্পদের তুলে ধরতে প্রযুক্তির দ্বারস্থ হন রজত। শুরু করেন একটি বিশেষ ইউটিউব চ্যানেল ‘মাটির কলা’। বর্তমানে এই চ্যানেলেই ধারাবাহিকভাবে নানান বিলুপ্তপ্রায় লোকশিল্পের বর্ণনা এবং বিশ্লেষণ করেন রজত। সময়ের অগ্রগতির সাথে ক্রমাগত অগ্রগতি ঘটছে সভ্যতার। ঘড়ির প্রতিটি টিক্-টিক্ শব্দ যেন মানব জাতির এই উন্নতির বার্তাবাহক। সময়ের ব্যাস্ততায় ও আধুনিকতার ধাক্কায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন সংস্কৃতি গুলিও। তবে এই তিন যোদ্ধার লড়াইয়ে ওড়িশার শহরাঞ্চলে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে প্রান্তিক শিল্পগুলিও। খানিকটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে প্রান্তিক শিল্পীদের আয়। প্রাচীন এই সংস্কৃতিগুলি সংরক্ষণ ও তাদের সম্পর্কে সকল সাধারণ মানুষকে জানানোই রজতের একমাত্র লক্ষ্য।
Discussion about this post