মিষ্টি ও বাঙালি অভিধান মতে দুই ভিন্ন শব্দ হলেও, বাস্তবে এই দুই যেন মিলে মিশে একাকার। বাঙালির শেষ পাত থেকে উৎসব অনুষ্ঠান মিষ্টি ছাড়া যেন সবই অসম্পূর্ণ। বাঙালির রসনা তৃপ্তিতে মিঠাইয়ের বরাবরই একটা আলাদা জায়গা ছিল। রসগোল্লার পাশাপাশি খাদ্যরসিক বাঙালির কাছে অন্যতম পছন্দের রসের মিষ্টি হল লাল বর্ণের পান্তুয়া। আর পান্তুয়ার আলোচনায় প্রথমেই মনে আসে পরাণের অসাধারণ স্বাদের ক্ষীর পান্তুয়ার কথা। রাজ্যের সরকারি থেকে বেসরকারি নানা অনুষ্ঠানে ঠাঁই পায় পরাণের এই পান্তুয়া। শোনা যায়, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে, প্রাক্তন ও বর্তমান সময়ের বহু নেতা মন্ত্রীরাও কাটোয়ার পরাণের পান্তুয়ার স্বাদ নিয়েছেন।
কাটোয়ার ১৭ নং ওয়ার্ডের বারোয়ারি তলায় অবস্থিত প্রাচীন এই দোকানটি। দোকানের বাইরে সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা ‘ক্ষীরের পান্তুয়া’। তবে কালক্রমে এলাকার মিষ্টি প্রিয় মানুষদের কাছে এই দোকান পরিচিত ‘পরাণের পান্তুয়ার’ নামেই। জানা যায়, স্বয়ং উত্তম কুমার তার ‘নিশিপদ্ম’ ছবির শুটিংয়ের সময় এই পরাণের পান্তুয়ার স্বাদ নিয়েছিলেন। পান্তুয়ার এই নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে বহু মত রয়েছে। কেউ বলেন, শব্দটির উৎপত্তি ‘পানিতুয়া’ শব্দ থেকে। আবার কেউ বলেন, ‘পানিতবা’ শব্দ থেকেই এসেছে পান্তুয়া কথাটি। ‘তবা’ কথার অর্থ ‘নিচে’। যেহেতু এই মিষ্টি চিনির রসে ডুবে থাকে তাই এইরূপ নামকরণ।
পরাণের এই পান্তুয়া তৈরীর পেছনে রয়েছে স্বাধীনতার পূর্বের কাহিনী। জানা যায়, সুদূর বাংলাদেশ থেকে গোপন রেসিপিযুক্ত এই ক্ষীরের পান্তুয়া এপার বাংলায় এসেছিল। সময়টা উনিশ শতকের একদম গোড়ার দিক। অবিভক্ত বাংলাদেশ থেকে রুটি রুজির টানে ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর থেকে কাটোয়ায় গঙ্গা তীরবর্তী বারোয়ারিতলায় আসেন সুরেন্দ্রনাথ কুণ্ডু। বারোয়ারিতলায় তিনি একটি ছোট্ট মিষ্টির দোকান শুরু করেন। প্রথমে দোকানে পাওয়া যেত মুরুলি, অমৃতি ও ক্ষীরের পান্তুয়া। তবে সময়ের সাথে সুরেন্দ্রনাথ মুরুলি, আমৃত তৈরি বন্ধ করে গ্রাহকদের চাহিদায় শুধুই লম্বা সাইজের ক্ষীরের পান্তুয়া তৈরি করতে শুরু করেন। সুরেন্দ্রনাথ বাবুর ছিলেন তিন ছেলে। তাদের মধ্যে ছোট ছেলে প্রাণকৃষ্ণ কুণ্ডু বাবার কাছে পান্তুয়ার গোপন রেসিপি শিখে শুরু করেন পান্তুয়া তৈরির কাজ। ধীরে ধীরে প্রাণকৃষ্ণ মানুষের কাছে ‘পরাণ’ হিসাবে পরিচিত হয়ে পড়েন। প্রাণকৃষ্ণ কুণ্ডুর মৃত্যুর পর বর্তমানে তার ভাইপো তপন ও সমরেশ কুণ্ডুর হাত ধরেই মানুষের কাছে পৌছে যাচ্ছে পরাণের পান্তুয়া। কাটোয়ার পরাণের এই ক্ষীরের পান্তুয়া জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যের বিভিন্ন শহরে পাড়ি দেয়।
দোকানের মিষ্টি প্রস্তুতকারকদের মতে, “সুস্বাদু এই মিষ্টি তৈরীর উপকরণগুলি হল দুধের খোয়া, জল ঝরানো ছানা, ময়দা, চিনি, এলাচ, ঘি ও খাবার সোডা। প্রথমে দুধের খোয়া ও ছানা আলাদা ভাবে হাত দিয়ে মসৃণ করে মাখতে হয়, যেন তাতে কোনও দানা না থাকে। তারপর ময়দার মধ্যে ঘি দিয়ে আলাদা ভাবে ভালো করে মেখে নিতে হয়। এরপর তিন ধরণের মিশ্রণ একসাথে মিশিয়ে তাতে চিনি, এলাচ গুঁড়ো আর খাবার সোডা দিয়ে আরো ১-২ মিনিট মেখে নিতে হয়। তারপর ওই মণ্ড থেকে লেচি কেটে হাতে ঘি মাখিয়ে সেটিকে গোল আকারের বানিয়ে ডুবো তেলে কম আঁচে লাল করে ভাজতে হয়। অন্য একটি পাত্রে জল আর চিনি দিয়ে আঁচে ৫-৭ মিনিট বসিয়ে মাঝে মাঝে নেড়ে রসটা তৈরি করতে হয়। সবশেষে ভেজে নেওয়া মিষ্টি রসে দিয়ে ১ মিনিট মতো ফুটিয়ে গ্যাস বন্ধ করে দিতে হয়।” সম্প্রতি রসগোল্লার পাশাপাশি পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার পরাণের পান্তুয়ারও রাজ্যের স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন গ্রাহক ও মালিকপক্ষ উভয়েই। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, সব দিক বিশ্লষণ করে খুব শীঘ্রই এই বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তাই বাঙালির মিষ্টান্ন ঐতিহ্য পরাণের পান্তুয়াকে রাখতেই পারেন বিজয়ার হট লিস্টে।
Discussion about this post