ধৈর্যের আরেক নাম হালিম। এই ধৈর্যতেই স্বাদ বেড়ে বাহাত্তর হয় হালিমের। ধৈর্য কি কেবল প্রণালীতে, সুদূর পারস্য দেশে জন্ম নিয়ে বিদেশ ঘুরে হায়দেরাবাদের রাস্তা হয়ে বাঙালির নাগালে এসেছে এর স্বাদ। সে প্রায় তিনশো বছরেরও বেশি সময়ের কথা। আরও পিছিয়ে ষষ্ঠ শতকে পৌঁছে গেলে জানা যায় এর জন্মলগ্নের কাহিনী। সব মিলিয়ে হালিমের বয়স কয়েক হাজার বছর। আর বানাতে লাগে বারো ঘন্টারও বেশি সময়। কিন্তু খুসবুতে জিভে জল আসে মিনিটেই।
পারস্য দেশে রাজা খুসরোর সময়ে এর প্রচলিত নাম হারিসা। প্রায় পাঁচ রকমের ডাল, সুগন্ধি চাল, গম, মশলা, জাফরান, ঘি, গাজর, শালগম, পালং, মৌরি আর মাংসের টুকরো দিয়ে তৈরি এক ধরনের এই স্ট্যু ক্ষুধা-শ্রান্তি দূর করতে ছিল মোক্ষম এক খাবার। ক্রমে রমজানে উপোসী শরীরেও শক্তি এনে দিত। এক সময় সৈন্য-সেপাইদের শরীরে বল আনতে খাওানো হত সেদিনের হারিসা। মোগলরা পারস্য দেশ জয় করলে পরিচিতি ঘটে হারিসা উরফ হালিমের সাথে। সেই পথ ধরেই ভারতে আগমন। ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান আর বাংলাদেশেও। এখন জনপ্রিয়তা এমনই, বাঙালি রমজান মাস এলেই স্বাদ চেখে নিতে ভিড় জমায় কলকাতার রেস্তোরায় আর পথে ঘাটে। হালিম আধিপত্য বিস্তার করেছিল আকবরের রসুইখানাতেও। ইবন বতুতার লেখা ও পরবর্তীকালে ‘আইন-এ-আকবরী’ গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে।
খাবার বানানোর প্রণালী আর উপকারিতার দিকটি দেখলে এর সাথে মিল পাওয়া যায় আমাদের খিচুড়ির। ফারাক শুধু মাংসের। চাল, ডাল, সবজি, ঘি দিয়ে চটজলদি খাবার খিচুড়ি। পাকিস্তানে এই হালিম পরিচিত খিচড়া নামে। স্বয়ং আকবর ছিলেন নিরামিষাশী। তাই তাঁর আমলে জনপ্রিয় হয়েছিল নিরামিষ হালিম। স্থান ও হাত বদল হয়ে ক্রমে এসেছে মাংস দিয়ে রান্নার প্রচলন। খাদ্যরসিক বাঙালির কাছে ধর্মের বেড়াজাল পেরিয়ে স্বাদের অঙ্কে হালিম তাই ফুল মার্কস, এখনও। কলকাতা কোনো দিনই জাত-পাত-ধর্মের নিরিখে কোনো গন্ডি মানেনি। খাবারের ক্ষেত্রেও অক্ষুণ্ণ থেকেছে এই আপন করে নেওয়ার প্রবণতা। তাই জিভের স্বাদে সব সীমানার বাধা পেরিয়ে হালিম আজকে কলকাতা শহরের এক অন্যতম আকর্ষণ। কলকাতার রেস্তোরাগুলোতে হালিম পাওয়া যায় শুধু রমজান মাসেই। অতএব, ক্ষণিকের অতিথি। তাই আতিথেয়তা করতে ছিটেফোঁটা কার্পণ্য করতে নারাজ শহরবাসী।
সুস্বাদু হালিমের উপাখ্যান কয়েক হাজার পাতা লিখলেও মন ভরবে না। তবে হরিসা কিভাবে আমাদের ভারতবর্ষ হয়ে কলকাতায় ঢুকে গেল, সেই বিবর্তনের ইতিহাস নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। হালিমের স্বাদের মতোই এই আখ্যান এক কথায় চমৎকার।
Discussion about this post