“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে” বা “মরণ রে,তুঁহুঁ মম শ্যামসমান” মৃত্যু নিয়ে দার্শনিকতায় রবীন্দ্রনাথের গভীরতা ছিল অন্য সব বিষয়ের মতোই অপরিসীম। প্রতিটি প্রিয়জনের জীবনবিয়োগের ঢেউ তাঁকে পোক্ত করেছে সমুদ্রতীরের মতো। সব কারণ মিলিয়েই তিনি আকর্ষিত হয়েছেন বারবার মৃত্যুর দিকে। লিখেছেন একাধিক গান। এমনকি তিনি বারবার প্রিয়জনকে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে আয়োজন করেছেন প্ল্যানচেটের। প্রকাশক বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের মেয়ে উমা দেবী ওরফে বুলা হয়েছেন তাঁর মিডিয়াম। ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ভারতী’ পত্রিকার আশ্বিন,১৩০১ সংখ্যায় এক অদ্ভূত যন্ত্রের বিজ্ঞাপন প্রকাশ পেয়েছিল।” নির্মাতা শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্য,১০৮, আপার চিৎপুর রোড, গরাণহাটা, কলিকাতা, মূল্য আড়াই টাকা, প্যাকিং ও ডাকমাশুল বারো আনা”। রবীন্দ্রনাথই যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন , – ‘প্রেতবাণীবহ চক্রযান’।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে সুকুমার রায় সবাই তাঁর প্ল্যানচেটে নেমেছিলেন পৃথিবীতে। মধুসূদনের সঙ্গে রবির আলাপ হয়েছিল প্ল্যানচেটের মাধ্যমেই। কৈশোর বয়স থেকেই রবি ছিলেন এই প্রেতচক্রের অংশীদার। এই সমস্ত ঘটনার বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ কাব্যগ্রন্থ থেকে। অমিতাভ চৌধুরীর লেখা ‘একত্রে রবীন্দ্রনাথ’ কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চার একটি অধ্যায়ও রয়েছে। যেখানে রাণী মহলানবীশকে লেখা একটি চিঠির সূত্র রয়েছে।
কুড়ি একুশ বছর বয়সের পর আবার প্রায় আটষট্টি বছর বয়সে তিনি আবার আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই প্ল্যানচেটের সঙ্গী হতেন মীরা দেবী, নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখরা। সুকুমার রায় তাঁর একমাত্র পুত্রকে দেখার কথা বলেছিলেন বিশ্বকবিকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,”কেমন আছ তুমি!”, সুকুমার বলেছিলেন,” অন্য কথা বলুন”। এরপর রবি ঠাকুর বলেন “পৃথিবীর সাথে এখন তোমার যোগাযোগ আছে?” তিনি বলেন,” নিশ্চয়ই, যোগাযোগ আছে। আমার পৃথিবীর নেশা আজও কাটেনি। তাই পরলোকের সুর আজও মনে লাগে না।”
তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বার বিধবা প্রতিমাদেবীর বিবাহ প্রসঙ্গে। আরেকজনও বারবার এসে পড়তেন আত্মপরিচয় গোপন রেখে। তিনি ছিলেন কবিপ্রিয় নতুন বৌঠান। প্ল্যানচেটে আগতরাই তাঁর ছবির ইউরোপে স্বীকৃতি পাবার কথা আগাম জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অনেকের অনুরোধে শুনিয়েছেন গানও। এছাড়াও কবির বিশেষ আগ্রহ ছিল শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। কবি তিনটি বিশেষ প্রশ্ন রাখতেন এই বিদেহী আত্মাদের থেকে,১) তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তন হয়েছে কিনা,২)পরলোকে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক কিরকম,৩) নতুন জন্ম নিতে ইচ্ছে হয় কিনা। বিখ্যাত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ জগদীশ ভট্টাচার্যের কবিমানসীর প্রথম খন্ডে রবীন্দ্রনাথের প্রেততত্ত্বে আগ্রহ নিয়ে লেখা আছে স্পষ্টভাবে।
রবীন্দ্রনাথকে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, “জানাটা এতটুকু। না জানাটা অসীম। সেই এতটুকুর উপর নির্ভর করে তো চোখ বন্ধ করে রাখা চলে না।” তিনি আরো বলেছিলেন, “যে বিষয় প্রমাণও করা যায় না, অপ্রমাণ ও করা যায় না, সে সম্বন্ধে মন খোলা রাখাই উচিত। যে কোন একদিকে ঝুঁকে পড়াটা গোঁড়ামি।” বুলার সম্পর্কে বলতেন “ও কেন মিথ্যে বলবে, কী লাভ ওর ছলনা করে! ও যা বলেছে তা ওর বিদ্যাবুদ্ধিতে সম্ভব নয়।”
Discussion about this post