মাঠে ধান কাটা শেষ। পৌষপার্বণে মাতোয়ারা বাঙালি শুধু এদেশে নয়, বাংলাদেশের অলিগলিতেও। নতুন ধানে পল্লীবাংলার গোলা ভরে উঠেছে। আর সেই নতুন ধানের বরণ উৎসবই হল মকরসংক্রান্তি। গোটা বাংলাদেশে জুড়েই চলে উৎসবী আমেজটা। বাংলা সংস্কৃতিতে এটি একটি বিশেষ উৎসবের দিন। হিন্দুরা এই দিনটিতে পিতৃপুরুষ অথবা বাস্তু দেবতার উদ্দেশ্যে তিল কিংবা খেজুড় গুড় দিয়ে তৈরি তিলুয়া এবং নতুন ধান থেকে তৈরি চালের পিঠে অর্ঘ্য দিতেন। এই কারণে পৌষ সংক্রান্তির অপর নাম তিলুয়া সংক্রান্তি বা পিঠে সংক্রান্তি। মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যে পিঠে ও পিঠে গড়ার বিচিত্র সব উপাখ্যানের বিস্তৃতি রয়েছে।
বাংলাদেশের আঁকেবাঁকে আমন ধানের খড় কেটে এনে মজুদ করা হয়। খড় আর কাঁচা বাঁশ দিয়ে তৈরী করা হয় ছোট মেরামেরীর (মেষ)ঘর। সেই ঘরের এক পাশেই তৈরী হয় ভাত, মাছ, মাংস ও চুঙা পিঠা, চলে নগরকীর্তন। কমলা, নারকেল, নকুল দানা, বাতাসা, কলা, খিরা, কদমা ও অন্যান্য সামগ্রী ছড়ানো হয় গ্রামবাসীর মধ্যে। মজার গপ্পগুজব চলে রাতভোর। পরের দিন কাক ভোরে সবাই ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে রাতে তৈরী করা ঘরটিতে আগুন দেন। সে আগুনেই সবাই মিলে আগুন পোহান। আগুনে তাপ নেওয়ার সময় কাঁচা বাঁশের আখি যখন পুড়ে ফাটে তখন গুলির শব্দের মতো একটি শব্দ হয়। আর সেই শব্দ কানে এলেই সবাই উচ্চ স্বরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। রয়েছে হাসি-ঠাট্টা ভরা বাক্য বিনিময়ের প্রথাও।
এই উৎসবকে ঘিরে গ্রামীণ জনপদে যেন উচ্ছ্বাসের ঢল নামে। প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে উজ্জ্বল মাটির হালকা আস্তরণ লেপে দেওয়া হয়। উঠোনে চালের গুড়ি, রঙিন মাটি ও বিভিন্ন রং দিয়ে আঁকেন হরেক রকম আল্পনা। মৌলভীবাজারের শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর তীরে প্রায় দু’শো বছর আগে থেকে এইসময় চলে এক মাছের মেলাও। পৌষের শীত গায়ে মেখে এভাবেই আনন্দের মেজাজে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বাংলাদেশ।
এই সংক্রান্তিতেই একটুকরো নীল আকাশে ছেয়ে যায় রঙবেরঙের ঘুড়ি। যাকে শাকরাইন বলে থাকে বাংলাদেশের মানুষ। বাজারে নাটাই ঘুড়ি মাঞ্জার রকমারি বাহারে চোখ জুড়িয়ে যায়। বের হয় শোভাযাত্রা। ক্লাবে ক্লাবে বিশেষ ঘুড়ির প্রতিযোগিতা। সকালে রঙীন আকাশ রাতে ভরে আলোর রোশনাইতে। আতসবাজির খেলায় মুগ্ধ হয়ে পড়ে সবাই। শুধু কি আগুনের খেলা? ড্রাগন সেজে মুখ থেকে আগুনের হলকা বের করতে থাকে গলগল করে কত মানুষ। পোষাকি ভাষায় ‘ফায়ার ব্রিদিং’। এটি শাকরাইনের অন্যতম প্রধাণ আকর্ষন। এইভাবেই পৌষ-পার্বণের খুশির আমেজে মেতে ওঠেন বাংলাদেশের প্রতিটি ঘর।
Discussion about this post