মিষ্টি মানেই বাংলা ও বাঙালি। রসে ভেজা মিষ্টি হোক কিংবা শুকনো সন্দেশ সবই বাঙালির শেষ পাত থেকে আনন্দ-অনুষ্ঠানের সঙ্গী। বঙ্গদেশের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন স্বাদ ও গঠনের বহু মিষ্টি। তাদের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য শরীয়তপুরের অন্যতম মিষ্টি নড়িয়া সন্দেশ। যুগ যুগ ধরে সুনামের সঙ্গে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে এই সন্দেশ। এই সুস্বাদু মিষ্টির সাথে জড়িয়ে আছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নাম। এলাকার নাম ছড়িয়ে দিতে ও সন্দেশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই নাম দেন এখানকার মিষ্টান্ন দোকানিরাই।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা সুপরিচিত সন্দেশের এলাকা হিসেবে। জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে নড়িয়া সন্দেশের জন্ম হয়। নড়িয়া বাজারের ঘোষেরাই এই সন্দেশের প্রবর্তক। এই বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলছে কীর্তিনাশা নদী। ব্রিটিশ আমল থেকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। তৎকালীন সময়ে কীর্তিনাশায় বড় বড় স্টিমারে করে যাতায়াত করতেন দক্ষিণ অঞ্চলের ব্যবসায়ীসহ ব্রিটিশরা। তাঁরা যাত্রাবিরতিতে নড়িয়া ঘাটে নেমে এই সন্দেশ খেতেন ও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। যার ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই নড়িয়া সন্দেশের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
এই ভিন্ন ধরনের মিষ্টিতে থাকে গরুর টাটকা দুধের ঘ্রাণ। নড়িয়া ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের পরিচালক পরিমল ঘোষ বলেন-” সাধারণত ছয়-সাত কেজি দুধে এক কেজি ছানা পাওয়া যায়। সেই ছানার সঙ্গে এক কেজি চিনি মিশিয়ে অল্প জ্বাল দিতে হয়। ২০ থেকে ৩০ মিনিট পাকিয়ে অল্প আঁচে পাঁচ মিনিট রাখলেই কাঁচামাল তৈরি হয়। তা পরিমাণমতো নিয়ে গোল করে হাতের ওপরে রেখে চাপ দিয়ে সন্দেশের আকার দেওয়া হয়। প্রতি কেজি নড়িয়া সন্দেশের দাম ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। কেজিতে ২৫টির মতো থাকে।” এই অসাধারণ মিষ্টির স্বাদ নিতে আসেন নড়িয়া উপজেলা সহ আশেপাশের বহু মানুষ। সময়ের সাথে সাথে এই মিস্টির চাহিদা বেড়েছে বিদেশেও। শরীয়তপুরের প্রবীণ ব্যক্তিত্ব, কবি ও সাহিত্যিক শ্যামসুন্দর দেবনাথ বলেন, “নড়িয়া সন্দেশের কদর আদিকাল থেকেই। এ শহরের কোনো ব্যক্তি মেয়েজামাইয়ের বাড়িতে কিংবা কোথাও বেড়াতে গেলে তার হাতে আর কিছু না থাকলেও সন্দেশের প্যাকেট থাকবেই। বিদেশিরাও এই মিষ্টান্নের প্রশংসায় পঞ্চমুখ বলে প্রবাসীরা জানান।”
তবে সময়ের সাথে বেড়ে চলা মূল্যবৃদ্ধি ও খাঁটি দুধের সংকটের কারণে ক্রমশ কমে আসছে এই মিষ্টি তৈরী। আগে নড়িয়া উপজেলার বহু দোকানে এ মিষ্টি পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা কমে ঠেকেছে হাতে গোনা কিছু দোকানে। সন্দেশের কারিগর বিমল ঘোষের মতে, “দুধ, চিনি এবং শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় এখন খুব একটা লাভ টেকে না। তবু ঐতিহ্য ধরে রাখতে মানের সঙ্গে আপস না করেই ব্যবসায় লেগে আছি। এই সন্দেশ আমার দাদা বিক্রি করেছেন, বাবা করেছেন, আমিও করছি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই ঐতিহ্য ও ব্যবসা টিকে থাকুক- এটাই আমার আশা।” তাই কোনোদিন শরীয়তপুরের কাছাকাছি গেলে এই মিস্টির স্বাদ নিতে ভুলবেন না।
Discussion about this post