বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জেলা ময়মনসিংহের একটি উপজেলা হল মুক্তাগাছা। কালের সাক্ষী হয়ে শতাব্দী প্রাচীন মুক্তাগাছা জমিদারবাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে আজও। কিন্তু তার পাশাপাশি এখানে রয়েছে এমন একটি জিনিস, যার ঐতিহ্যও জমিদারবাড়ির থেকে কোনো অংশেই কম নয়। তা হল, মুক্তাগাছার সুপ্রসিদ্ধ মণ্ডা! যার খ্যাতি ও সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। কিন্তু কী এমন কারণ, যার জন্য এটি এত জনপ্রিয়?
মণ্ডা হল একটি গোল চ্যাপ্টাকৃতির বাঙালি মিষ্টান্ন, যাকে দেখতে কিছুটা প্যাড়ার মত। প্রথমে চিনি মিশ্রিত কড়া পাকের ক্ষীর গরম অবস্থায় গোল করে পাকিয়ে তৈরি করা হয় মণ্ড। এরপর কারিগররা হাতের দক্ষতায় এটিকে আকার দেন। ক্ষীরের রঙের উপর নির্ভর করে মণ্ডা সাদা বা হাল্কা খয়েরি রঙের হয়। মুক্তাগাছাতে শীতকালে সাধারণত আরও এক ধরনের মণ্ডা পাওয়া যায়, যা চিনির পরিবর্তে খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি হয়। এটি তৈরির পর ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয় না। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গরমের সময় ৩-৪ দিন ও শীতকালে ১০-১২ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে। নাটোরের কাঁচাগোল্লা, বর্ধমানের মিহিদানা-সীতাভোগ, শক্তিগড়ের ল্যাংচার মত এই মুক্তাগাছার মণ্ডা নিয়েও কিন্তু প্রচলিত রয়েছে নানা কিংবদন্তী ও ইতিহাস!
১২০৬ সন বা ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন এই মণ্ডার জন্মদাতা রামগোপাল পাল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর রামগোপালের পিতা রামরাম পাল ১২৩০ সনে মালদহ থেকে রাজশাহী হয়ে মুক্তাগাছার তারাটি গ্রামে বসবাস শুরু করেন। পরিবারের পঞ্চম বংশধর রমেন্দ্রনাথ পালের ‘মণ্ডা আলেখ্য’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রামগোপাল পাল নাকি স্বপ্নে প্রায়ই এক সাধুর দেখা পেতেন। তিনিই তাঁকে মণ্ডা তৈরির নিয়মাবলী শেখাতেন। এরপর রামগোপাল সাধুর আদেশমত চুল্লি খনন শুরু করেন ও সেই চুল্লিতেই ১২৩১ সনে প্রথমবার তৈরি হয় এই মণ্ডা। রামগোপাল তাঁর বানানো মণ্ডা পরিবেশন করেন তৎকালীন মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর দরবারে। শোনা যায়, মণ্ডা খেয়ে পরম তৃপ্তি পেয়েছিলেন মহারাজা। সেই সময় জমিদারদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের মণ্ডা দিয়েই আপ্যায়ন করা হতো। শুধু কি তাই? ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ডা: বিধানচন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ ব্যক্তিদের মুক্তাগাছার জমিদারবাড়িতে আপ্যায়ন করা হয়েছে এই মণ্ডা দিয়েই!
বর্তমানে শ্রী রমেন্দ্রনাথ পাল ও তাঁর ভাই রবীন্দ্রনাথ পালই ব্যবসা চালান। তাঁদের কাছ থেকে আরও জানা যায়, এই মণ্ডার স্বাদে মুগ্ধ হয়েছিলেন পাকিস্তানের আয়ুব খান, আবদুল হামিদ খান, এমনকি চীনের মাও-সে-তুংও। রাজা সূর্যকান্তের পুত্র শশীকান্তও খুব ভালোবাসতেন এই মণ্ডা। তাঁর সাথে সুসর্ম্পক ছিল রাশিয়ার বিখ্যাত নেতা স্ট্যালিনের, যাঁকে বাংলাদেশের এই বিখ্যাত মণ্ডা উপহার পাঠান তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও নাকি এর স্বাদে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি তাঁর দেশের বিশেষ অতিথি তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকেও খাইয়েছিলেন এই মিষ্টি। পরবর্তীতে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় মণ্ডার অনেক শংসাপত্র হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু মুক্তাগাছার জমিদার শ্রী জীবেন্দ্র কিশোর আচার্য চৌধুরী ১৯৫৩ সালে নিজস্ব প্যাডে এই মণ্ডার যে প্রশংসাপত্র পাঠান, তা আজও বাঁধিয়ে দোকানের দেওয়ালে টাঙানো। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি কী জানেন? প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মণ্ডার গুণগত মান কিন্তু আজও এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি! সম্ভবতঃ, একমাত্র মুক্তাগাছাতেই বংশপরম্পরায় গোপন রেসিপিতে বানানোই রয়েছে এর নেপথ্যে। কাজেই মিষ্টিপ্রেমী প্রত্যেক বাঙালির জীবনে অন্ততঃ একবার এই মণ্ডার স্বাদ উপভোগ করাই উচিত, কী বলেন?
তথ্য এবং চিত্র ঋণ – অরিন্দম বসু
Discussion about this post