উত্তরে হিমালয় দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রই মধ্যেই রয়েছে যেন একটি নিজেস্ব বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। আর এর সাথেই পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে নানা অজানা ইতিহাসও। প্রত্যেক জেলার রয়েছে নিজেস্ব বিভিন্ন ঐতিহ্য। এমনই এক ঐতিহ্য তথা ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের রথ উৎসবে।
দাসপুরের তিয়রবেড়িয়ার বিখ্যাত রথ যাত্রার বয়েস প্রায় ১১০ বছরেরও বেশি। অবিভক্ত মেদিনীপুরের এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বড়ো রথ যাত্রার উৎসব। এই রথ যাত্রার মূল আকর্ষণ হল ৮০ মণের পিতলের রথ। পাঁচটি চূড়াযুক্ত এই রথের উচ্চতা প্রায় ২৫-২৬ ফুটের কাছাকাছি। অখণ্ড মেদিনীপুরের দাসপুরের জমিদার তখন ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত। এই গ্রামের আদি বাসিন্দা না হলেও বাবা বলরাম সামন্তের সাথেই পুরো সামন্ত পরিবারের এই গ্রামে আসা। আর এই সামন্ত পরিবারেরই কুল দেবতা শ্রী শ্রী মদনগোপাল জিউয়ের মূর্তি বিরাজ করে এই পিতলের রথে। এই রথের চার কোণে যে মন্দির আছে তাতে রাখা হয় ৪জন ঋষিকে আর একেবারে মাঝে রত্ন বেদীতে বিরাজ করছেন শ্রী শ্রী মদন- গোপাল জিউ এবং রাধারানীর বিগ্রহ। রথের চূড়ার মাথায় রয়েছেন বিষ্ণু বাহন গড়ুরদেব। এইজন্যই এই রথের নাম রাখা হয় গড়ুর ধ্বজ। রথের একবারে সামনের দিকে ঘোড়া এবং সারথী সাত্যকি। আর চূড়াতে রয়েছে লাল রঙের ৫ টি ধ্বজা বা পতাকা। সব মিলিয়ে এই রথের রয়েছে নিজস্ব একটি ঐতিহ্য। আর বিশাল আকৃতির এই রথই বিশেষ আকর্ষণ এই উৎসবে যা দেখতে পাশের গ্রাম থেকেও ছুটে আসে মানুষ।
নয় দিন ধরে রথ উৎসব উদযাপিত হয়। উৎসবের দিনগুলিতে চলে নানা নিয়ম আচার। রথের আগের দিন হয় নেত্র উৎসব অর্থাৎ রথকে ভালো করে পরিষ্কার করে সাজানোর উৎসব। এই রথের নিয়ম জুড়ে সামন্ত বাড়িতেও রয়েছে নানা রকমের মান্যতা। কুলদেবতার বিগ্রহের পায়ে নুপূর থাকার জন্য সামন্ত পরিবারের স্ত্রী’রা পায়ে মল পরেন না। রথের সাথে বিখ্যাত এখানকার রথের মেলাও। প্রথম দিকে যদিও রথকে কেন্দ্র করে কোনো মেলা হত না! কিন্তু পরের দিকে বড়ো মেলার আয়োজন হয় এবং ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেক বছরই তা হয়৷ এই মেলার আবার একটি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। তা হলো মেলার বিখ্যাত তালপাতার পাখা এবং চারা গাছ বিক্রি। মেলাতে চারা গাছ বিক্রি এক অভিনবত্বই বটে! আর এই মেলায় এটি বিক্রির পরিমাণও অত্যাধিক। সব মিলিয়ে তালবেড়িয়ার মানুষের কাছে রথ উৎসব এক বিরাট মিলন উৎসব যেন। হৈ-হুল্লোড় করে এই নয়টা দিন মেতে থাকে গ্রামের কচিকাঁচা থেকে শুরু করে প্রবীণরাও। যদিও এ বছর মহামারী বেড়ি পড়িয়েছে রথ-পার্বণের পায়ে। তবুও গ্রামবাসীদের বিশ্বাস মহামারী মুক্ত বিশ্বেই আগামী বছর টান পড়বে রথের দড়িতে।
চিত্র এবং তথ্য ঋণ – মেদিনীপুরের পুজো – Dekhbe Thakur Tumio, সুমন সামন্ত
Discussion about this post