কথায় বলে,”জিলিপির আড়াই প্যাঁচ”। জটিল কুটিল মনের মানুষকে বোঝাতেই এমন চলতি কথা। কিন্তু ওই কথার স্বাদ যতটা তেতো, ঠিক ততটাই সরস লোভনীয় খাবার জিলাপি। প্যাঁচানো হলদেটে রসে ভরপুর। চোখের সামনে থাকলে জিভে জল আসতে বাধ্য। বাংলায় এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে জিলিপি তার পসরা সাজিয়ে বসেনি। আর গ্রামবাংলার মেলাতে, জিলিপি কিনতে সে একরকম ঠেলাঠেলির জোগাড়। মিষ্টি জগতের বরাবরের সেলিব্রেটি এই মিষ্টিকে নিয়ে গল্পের থুড়ি ঘটনার ঘনঘটা কিন্তু নেহাৎ কম নয়। চলুন এক অজানা মজাদার গল্প শোনানো যাক।
শোনা যায়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে একসময় এই জিলিপির আসর বসত। কারণ স্বয়ং কবি যে ছিলেন জিলিপির পরম ভক্ত। কবি নাকি প্রায়ই নতুন নতুন মিষ্টির ফরমাইস নিয়ে হাজির হতেন মৃণালিনী দেবীর কাছে। আর উৎসাহ নিয়ে তা নিজে হাতে বানিয়ে পরিবেশনও করতেন কবির সহধর্মিণী। এমনই একদিন আর্জি এল, ‘মানকচুর জিলিপি’। মৃণালিনী দেবী অবশ্য তা উপহাস করে এড়িয়ে যান প্রথমে। কিন্তু পরে একদিন সেটি তৈরী করে হাজির করলেন। বলাই বাহুল্য, সাদামাটা জিলিপি থেকে তা ছিল বহুগুণ সুন্দর। তবে কবির এই অদ্ভুত মর্জি হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ বাংলার প্রথম রন্ধনশিল্পের বই ‘পাকরেজেশ্বর’-এ বিভিন্ন কচুর জিলিপির প্রণালী মেলে। হ্যাঁ, মানকচুর মত নীরস সবজি দিয়েও রসে টইটুম্বুর জিলিপি বানানো যায়। এ যেন কল্পনাতীত।
কেমন করে বানাবেন ভাবছেন তো? তবে প্রণালীটা চলুন ঝালিয়ে নেই। মানকচু জলে সেদ্ধ করতে হবে। ময়দার (পানিফল আটা) সঙ্গে মিশিয়ে ও ফেনিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে অনেকটা সময়। লেহ ঘন হলে ছিদ্রযুক্ত কাপড়ে আর তরল হলে ছিদ্রযুক্ত নারকেল মালায় ঢালতে হবে। এবার গরম তেলে প্যাঁচ কষে ভাজা শুরু করুন। ভাজা হলে চিনি রসে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে রাখলেই তৈরী মুচমুচে রসালো জিলিপি।
জিলিপির ইতিহাসও বহু পুরোনো। এর লিখিত বর্ণনা তেরশো শতাব্দীর রান্নার বইতে পাওয়া যায়। মিশরের ইহুদীরাই প্রাচীন এই মিষ্টিটি আবিষ্কার করেন বলে একটি মত প্রচলিত রয়েছে। মধ্যযুগে তুর্কিরা ভারতে নিয়ে আসে এই খাবারটি। প্রায় ১৬০০ খ্রী:পূ: সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থে জিলিপির এক উপকরণ তালিকা ছিল। অবিশ্বাস্যভাবে আজও তা এক রয়ে গিয়েছে।। ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত ছাড়াও নেপাল, পাকিস্তানে জিলিপির জনপ্রিয়তা চিরকাল তুঙ্গে। কিন্তু মানকচুর জিলিপি, এ হল বাংলার বিশেষত্ব। আর যেখানে রবীন্দ্রনাথ খোদ করতেন সেই জিলিপির কদর, সেই জিলিপির চাহিদাই অন্যরকম।
Discussion about this post