কালো মেঘে ঢাকা থমথমে আকাশ। ক্ষণে ক্ষণেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির নাচন। জিলাপি আর পাঁপর ভাজার ভুরভুরে বাজারি গন্ধ। জমজমাট ভূতুড়ে গল্পের আসর। আর এই মরশুমেই দু’ভাই তার ছোট্ট বোনের হাত ধরে নতুন পোশাকে সেজেগুজে তৈরী। তাদের যে এবার মাসির বাড়ি যাওয়ার পালা। সারি সারি ভক্তের স্রোতে হেলেদুলে চলবে এবার জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম। পার্বনে ভরা ভারতে আজ রথযাত্রার উল্লাস। যদিও এটি মূলত বাংলা ও ওড়িশার একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। তবুও শুভকামনার আদান প্রদান চলে গোটা দেশজুড়েই। এমনকি বিদেশের মাটিতেও গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলে রথের চাকা। পুরাণের পুঁথি থেকে উঠে আসা কিছু কাহিনীকে ভিত্তি করেই আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে পালন হয় রথযাত্রার উৎসব। সেই খুশিতেই আলোয় ঝলমল করে ওঠে পুরীর জগন্নাথ ধাম। আর পুরীর সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে মহিষাদলের শতাব্দী প্রাচীন রথযাত্রা।
পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ি। যার অলিগলিতে গেঁথে কতই না অজানা রহস্যের জট। রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর রাজরানী জানকী দেবী রাজসভার দায়িত্ব নেন। নদীতে ভাসমান শালগ্রাম শিলার স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি রাজবাড়ির সামনেই ১৭৭৪ সালে নির্মান করেন ১০০ ফুট উচ্চতার গোপাল জীউর মন্দির। আর সেই মন্দিরের হাত ধরেই ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শুরু হয় রাজবাড়ির রথযাত্রা উৎসব। ১৭ টি চূড়া ও ৩৪ টি লোহার চাকা দিয়ে সাজানো হয়েছিল চারতলা বিশিষ্ট কাঠের প্রকান্ড এক রথ। যেটি তৈরীতে সেই আমলেই গচ্চা গিয়েছে প্রায় ৬০ হাজার সিক্কা। তবে বলরাম সুভদ্রা নন জগন্নাথের সঙ্গী হন এখানে গোপাল জীউ ও রাজ রাজেশ্বরী। রথের দিন সকালে তিনটি মূর্তিকে সযত্নে তোলা হয় ফুলবাহারে সজ্জিত ওই রথে। একই সাথে রাজবাড়ির গৃহদেবতা মদনগোপাল জীউর শালগ্রাম শীলা শ্রীধরও ওঠেন রথে।
আগে ছত্রধরের সাথে ডঙ্কা বাজিয়ে সাজানো পালকি চড়ে হাজির হতেন রাজপরিবারের বংশধর। কামান দাগা ও শিঙা ফোকার পরই রথের দড়িতে পড়ত টান। রথের সামনে দুলকি চালে হেঁটে যেত রাজবাড়ির দুটি হাতি। যার পিঠে বসা মাহুত লাল নিশানা দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলত রথ। চারিদিকে বেজে উঠত ঢাকের বাদ্যি, খোল করতালের ঝমঝম শব্দ। বিপুল জাঁকজমক ও আড়ম্বরে ছেয়ে যেত চারপাশ। দেশ বিদেশের অতিথিদের আমন্ত্রণও জানানো হত এই রথে। গুন্ডিচাবাটিতে পৌঁছে ন’দিন ধরে চলত প্রভুর সেবাপর্ব। ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ, রাখাল রাজা, কালীয়দমন, কৃষ্ণকালী, মৎস্য অবতার, কুর্ম অবতার, রাজবেশ, বরাহ অবতার ও নটবর নবরূপে পূজা পান গৃহদেবতা মদনগোপাল। ন’দিন ধরে গুন্ডিচাবাটিতে খুশির রোশনাইতে চলে মেলা, যাত্রাপালা, পুতুলনাচের জমাটি আসর। ফিরতি রথে নটবর সাজে মন্দিরে ফেরেন গৃহদেবতা মদনগোপাল।
সময়ের সাথে পা মেলাতে গিয়ে কিছু সংস্করণ হয়েছে বটেই কিন্তু হারয়নি আভিজাত্য ছোঁয়া। ১৩ চূড়ার নীলচে রথেই এখন আসন পাতা হয় বিগ্রহের। আজও রথযাত্রার শুভ সূচনা হয় রাজবাড়ির বংশধরের হাতেই। গুন্ডিচাবাটি জুড়ে আজও বসে একমাস ব্যাপী মেলার পসরা। উৎসব উপলক্ষ্যে চোখে মুখে লেগে থাকে ঝলমলে খুশির ঝলক। বয়স তরতরিয়ে বাড়লেও ঐতিহাসিক পরম্পরা আজও ঠিক একইভাবে ধরে রেখেছে মহিষাদলের রথযাত্রা।
চিত্র ঋণ – মানস কুমার পান্ডা, সৈকত জানা, পৃথ্বীশ রাজ কুন্তি
Discussion about this post