সময়টি ১৯৪২-এর বসন্ত। প্রায় দু’হাজার ইহুদি যুবতীকে নিয়ে দুটি ট্রেন স্লোভাকিয়া থেকে পোল্যান্ডের দিকে ছুটে চলেছেl জানলার কাঁচ দিয়ে শেষবারের মত বাইরের রোদ ঝলমলে দিন, সোনালী গমের ক্ষেত, ম্যাপেলের সোনালী পাতা ঝরা রাস্তা দেখছেন ট্রেনের যাত্রীরা। তাদের সমস্ত যন্ত্রনা, ভয়, চেপে রাখা কান্না যেন বাষ্পের মতো লেগে রয়েছে ট্রেনের সেই ঘষা জানালার কাঁচে। ট্রেন ছুটে চলল আউশভিৎজের পথে। সর্বশক্তিমান হিটলার মানব সভ্যতাকে দু’হাত ভরে দিয়েছিলেন হলোকাস্ট, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, এথেনিক ক্লিনজিং। আর দিয়েছিলেন আউশভিৎজ। তখন আউশভিৎজ নাম শুনলেই ভয়ে কপালে ঘামের বিন্দু জমতে থাকত। শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে যেত ভয়ের ঠান্ডা স্রোত! নামটা এক আতঙ্কের জন্ম দিত। গ্যাস চেম্বারের নারকীয়তার নাম ছিল ‘আউশভিৎজ’। ঠিক এর সঙ্গেই একটি অসমাপ্ত প্রেমের গল্পের নামও কিন্তু ছিল ‘আউশভিৎজ’। হেলেনা এবং ফ্রাঞ্জের জীবনের অসমাপ্ত এক প্রেম কথা।
সেই ট্রেনে ভীড়ে গাদাগাদি করে নিয়ে আসা মেয়েদের মধ্যেই একজন ছিলেন হেলেনা সিট্রোনোভা। ট্রেনের বাকিদের মতো তিনিও জানতেন তাদের শেষ পরিণতি। অসহায়তার সাথেই হয়ত শেষবারের জন্যই জীবনকে ছুঁয়ে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা। এরমধ্যেই হঠাৎ এক সকালে নাৎসী সেনারা এসে জানতে চাইলেন জন্মদিনের গান গাইতে পারে এমন কেউ আছে কিনা। শুনে এগিয়ে এলেন হেলেনা। মারা যাওয়ার আগে শেষবারের মত জীবনের গান গাইতে পারাও এক সৌভাগ্য, তিনি ভাবলেন। নাৎসী সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসার ফ্র্যাঞ্জ উন্স। জন্মদিনটা ছিল তাঁরই। কেক কাটার আগে সেভাবে হেলেনাকে ঠিক খেয়াল পড়েনি তাঁর। ক্যাম্প ভর্তি নারী শরীর, তার মধ্যে সে আলাদা বা ব্যতিক্রম কিছু তো আর নয়। জন্মদিনের গান গাইলেন হেলেনা। তাঁর জীবনের প্রতি সবটুকু ভালোবাসা, না পাওয়া প্রেমের যন্ত্রণা সমস্তটাই উজাড় করে দিলেন গানে। সে গান শুনে ফ্র্যাঞ্জ অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন হেলেনার দিকে। যদিও তিনি জানতেন একজন ইহুদি নারী শরীরকে শুধুমাত্র ভোগ করা ছাড়া অন্য কোনো কিছুরই অনুমতি তাঁর নেই l নিয়ম ভাঙার শাস্তি ছিল একটাই, গ্যাস চেম্বারের মৃত্যু।
হেলেনাও জানতেন নিজের শেষ পরিণতি। তবুও একে অপরের দিকে দৃষ্টি আটকে গেল তাঁদের। আউশভিৎজের স্যাঁতস্যাঁতে, কাঁটাজাল ঘেরা দেওয়ালে তাঁদের প্রেমের ছাপ পড়ল। হেলেনা লিখেছিলেন, সময়ের সঙ্গে তিনি বুঝতে পারছেন ফ্রাঞ্জকে কতটা ভালবাসেন তিনি। ফ্রাঞ্জ তাঁর জন্য নিজের জীবনের যে কত বড় ঝুঁকি নিয়েছেন সেটাও বোঝেন তিনি। হেলেনা আর ফ্রাঞ্জ কখনও নিজেদের খুব কাছাকাছি আসতে পারেননি। শরীর ভোগ করার নিয়ম শুধু ছিল, তাই ভালবাসার চুম্বন করা তাঁদের কখনই হয়ে ওঠেনি। তাঁরা দেখতে পারেননি ভবিষ্যত জীবনের স্বপ্নও। শুধু তাঁরা পরস্পরের মন ছুঁয়ে গিয়েছিলেন, প্রেম দেখেছিলেন একে অপরের চোখে। সেই অস্থির বাতাসেও একসাথে প্রাণভরে নিশ্বাস নিয়েছিলেন তাঁরা। সেই ভয়াবহ আবহাওয়াতেই ফুটেছিল তাদের ভালোবাসার গোলাপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজলে হেলেনা আর ফ্রাঞ্জ একে অপরের থেকে ছিটকে যান। যুদ্ধ থামার পরে ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেলেনাকে প্রায় পাগলের মত খুঁজে বেড়িয়েছিলেন ফ্রাঞ্জ। খুঁজেছিলেন ভেঙে পড়া আউশভিৎজের পরিত্যক্ত ব্যারাকেও। নাহ, হেলেনাকে কোথাও আর খুঁজে পাননি।
১৯৭২ সালে যুদ্ধ থামার প্রায় তিরিশ বছর পরে অস্ট্রিয়ায় প্রাক্তন নাৎসী অফিসার হিসেবে ফ্রাঞ্জ গ্রেফতার হন। তাঁকে তোলা হয় যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের বিশেষ আদালতে l ঠিক সেইসময় খবরের কাগজে তাঁর ছবি দেখে চিনতে পারেন হেলেনা সিট্রোনোভা। তিনি তক্ষুণি ছুটে আসেন সেই আদালতে। হেলেনা ও তার বোনের সাক্ষ্যেই প্রমাণিত হয় যে সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও তরুণ নাৎসী অফিসার ইহুদিদের প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। সেই কাজে কখনও সফল হয়েছিলেন, কখনও বা ব্যর্থ l যুদ্ধ অপরাধের শাস্তি থেকে মুক্তি পান প্রাক্তন নাৎসী অফিসার ফ্র্যাঞ্জ উন্সl পরে নিজের জবানবন্দীতে ফ্রাঞ্জ লেখেন, হেলেনার প্রেমে পড়ার পরই তাঁর নিজের মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে। তাঁদের অসমাপ্ত প্রেমের কাহিনী নিয়েই হেলেনা ২০০৫ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। ঠিক তার চার বছর পরেই মারা যান ফ্রাঞ্জ। হেলেনাকে জীবনের শেষ মুহুর্ত অবধি আগলে রেখেছিলেন তাঁর ফ্রাঞ্জ। বলা যেতেই পারে পৃথিবীতে হিংসা, ঘৃণা আর বিদ্বেষ যত বাড়ে, ততোবারই প্রেম তারই মধ্যে থেকে নতুন করে বাঁচার দিশা খুঁজে নেয়।
Discussion about this post