ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মদিন পেরোলো কিছুদিন আগেই। ভূপেন দত্ত জন্মেছিলেন ১৮৮০ খ্রীস্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন ইনি আবার কে! আচ্ছা, তাঁর পিতার নাম আইনজীবী বিশ্বনাথ দত্ত এবং মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। কলকাতার সিমলার বিখ্যাত দত্তবাড়িতে ভূপেন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল। এবার একটু খটকা লেগেছে? চেনা ঠেকছে? ঠেকারই কথা। কারণ, ওই একই বাড়িতেই, ওই একই বাবা মায়ের সন্তান হিসেবেই জন্মেছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। অর্থাৎ, বিবেকানন্দ। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁরই কনিষ্ঠতম ভাই।
অল্প বয়সে ভূপেন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট। শিবনাথ শাস্ত্রীর সংস্পর্শে এসে তিনি হিন্দু সমাজের ভেদাভেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। প্রমথ মিত্রের নিখিল-বঙ্গ বৈপ্লবিক সমিতিতেও যোগ দেন। তিনি যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভগিনী নিবেদিতা, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হন। এছাড়া, ইতালীয় বিপ্লবী ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডির আদর্শও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল বারবার। তিনি তাঁর অগ্রজ বিবেকানন্দের লেখা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। কলকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে উচ্চশিক্ষা ও রাজনৈতিক আদর্শের জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ।
আত্মবিস্মৃতির শিখরে থাকা বাঙালি ‘বিবেকানন্দের ভাই’ শুনলেই লাফিয়ে উঠবে। কিন্তু, ভূপেন্দ্রনাথকে নিয়ে জানতে গেলে দেখা যাবে, তিনি তাঁর দাদার চেয়ে একবারেই আলাদা। নিজের আদর্শে, বিশ্বাসে, কাজকর্মে থেকে গেছেন স্বতন্ত্র। তাঁকে চিনতে হলে আমাদের ‘বিবেকানন্দের ভাই’এর পরিচিতি জুড়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ‘সাপ্তাহিক যুগান্তর’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, বৈপ্লবিক আদর্শ প্রচারের জন্য ঘুরে বেরিয়েছেন বাংলার গ্রামে গ্রামে, ভোগ করেছেন কারাদন্ড, আবার আমেরিকাতে পড়াশোনা করতে করতে আকৃষ্ট হয়েছেন সমাজতন্ত্রে, মার্কসবাদী দর্শনে। পরবর্তীকালে সমাজতত্ত্ব এবং নৃতত্ত্বের গবেষণা করে তিনি হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধিও লাভ করেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভূপেন্দ্রনাথ বার্লিনে যান। টানা দুই বছর ঐতিহাসিক বার্লিন কমিটির সম্পাদক ছিলেন তিনি। ছদ্মবেশে দক্ষিণ ইউরোপেও গিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে বার্লিন কমিটি নিজেদের কর্মক্ষেত্র পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। জার্মান অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটি এবং জার্মান এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যও ছিলেন তিনি। ভারতের রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে লেনিনের সঙ্গে চিঠি চালাচালি হত তাঁর। ‘The Complete Works of Lenin’ গ্রন্থের ৪৫তম খণ্ডে সেগুলি সংকলিত আছে। তিনি ভারতে বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। অনুশীলন, যুগান্তর, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সসহ বিভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠীর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তাঁর। ছিলেন ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের একজন উৎসাহী ছাত্র ও গবেষক। স্বাধীনতার পরে ভারত সরকারের থেকে কোনো ভাতা নিতে তিনি অস্বীকার করেন। গৌরমোহন স্ট্রীটের গলিতে একা থাকতেন, একাই মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৬১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর।
Discussion about this post