স্ট্রিট ফুডের স্বর্গরাজ্য শুধুমাত্র কলকাতা বললে যেমন ভুল বলা হবে, তেমনই এ কথাও সত্যি, যে বাংলার স্ট্রিট ফুডের একমাত্র বাদশা ‘রোল’। যার স্বাদ পৃথিবীর আর অন্য কোথাও, অন্য কোনখানেই মেলেনা। মেক্সিকোতে পাতলা রুটির ভিতরে সবজি, মাংস পুরে তৈরি হয় ‘বারিটো’, চিনে মেলে ভাপানো রুটির ভিতরে মাংসের পুর ভরা ‘বাও’, আমেরিকায় পাউরুটির ভিতরে মাংস বা সসেজ পোরা ‘হটডগ’। বিভিন্ন দেশেই খোঁজ নিলে জানা যাবে রুটি বা পাউরুটির ভিতরে পুর ভরা খাবারের নাম। কিন্তু, কলকাতায়, রাস্তার ধারের তেলতেলে পরোটার মধ্যে পেঁয়াজ, লেবু, লঙ্কার ভিতরে ডিম বা মাংসের মোহময়ী সুবাসের কাছে যেন সবই নস্যি!
কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন রোলের দোকান হল নিজামস। এখানেই প্রথম রোলটি তৈরি হয়েছিল। শোনা যায়, বিশ শতকের শুরুর দিকে শেখ হাসান রাজা উত্তরপ্রদেশ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতা কর্পোরেশনে কাজ করতেন তিনি। এছাড়া তিনি কাবাব, পরোটার ব্যবসাও করতেন। একদিন এক সাহেব নাকি কাবাব খেতে চেয়েছিলেন হাতে তেল না লাগিয়েই। উপায়ান্তর না দেখে হাসান তাঁর স্ত্রীর কাছে সাহায্য চাইলে তিনি হাসানকে বুদ্ধি দেন কাবাবগুলিকে একটি পরোটার মধ্যে মুড়ে দিতে। এভাবেই তৈরি হয় রোল। অনেকে আবার বলেন, এক সাহেব ঘোড়ায় চড়ে কাবাব খেতে এসেছিলেন। সাহেবের তাড়াহুড়ো থাকায় হাসান কাবাবগুলিকে পরোটার মধ্যে মুড়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই নাকি তৈরি হয়েছিল কলকাতার রোল। হাসানের সেই দোকানটিই আজকের নিজামস্।
কলকাতায় রোল তৈরির প্রচলনের পর আজকের মত রোল কিন্তু শুধুমাত্র এগরোল বা চিকেন রোল নামে পরিচিত ছিল না। পরিচিত ছিল ‘কাঠি রোল’ নামে। কাঠি কেন? কারণ, কাঠিতে আটকানো কাবাবকে পরোটার মধ্যে পুরেই তৈরি হত রোল। সেই থেকেই নাম কাঠি রোল। বিশেষত্ব ছিল পরোটারও। পরোটাকে হতে হত পুরু এবং মচমচে। কিন্তু তা কোনোভাবেই যেন বাদামী না হয়। শুকনো পরোটাকে বড় তাওয়াতে এপিঠ-ওপিঠ করে, তারপরে তাকে ভাজা হবে তেলে। তারপর তাতে মাংস ভরে গুটিয়ে, কাগজে মুড়ে দিলেই তৈরি লোভনীয় কাঠি রোল। এখন অবশ্য যত্রতত্র বিভিন্ন স্বাদের, বিভিন্ন মানের, বিভিন্ন আকারের রোল মেলে।
রোলের তৈরির ইতিহাস যাই হোক না কেন, ছোট-বড় সকলের এক কথায় প্রিয় খাবারের মধ্যে অন্যতম হয়েই রয়েছে এখনও। মানুষ সবসময়েই নতুনের দিকে ঝুঁকেছে। নিত্য নতুন খাবার, খাবার ধরণ, দেশ-বিদেশের খাবারের স্বাদের আগমন ঘটেছে। আজকের ইন্টারনেটের যুগে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের খাবারের নাম, রেসিপি হাতের মুঠোয় এসে গেছে। এক কথায় অভিনব খাবারের সহজলভ্যতা বেড়েছে। কিন্তু, সামান্য বদল ঘটলেও কলকাতার রোলের চাহিদা বদলায়নি। বরং, হয়ে উঠেছে বাংলার খাবারের সংস্কৃতির একটি বড় অংশ।
Discussion about this post