আজকের সমাজে ঘর কন্যা থেকে ঘর চালানো সবকিছুতেই নারীরা অগ্রণী। সমাজের নানান বাঁকা দৃষ্টিভঙ্গি এবং লিঙ্গ বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েও নারীদের প্রতিনিয়ত চালিয়ে যেতে হয় টিকে থাকার লড়াই। এই সংগ্রাম কখনও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের, কখনও নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠার, আবার কখনও পরিবার ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য রাখার। নারীদের প্রতিদিনের এই সংগ্রাম একদিকে তাদের মানসিক শক্তি ও সহনশীলতা গড়ে তোলে, অন্যদিকে সমাজের পুরোনো ধারণাগুলোকে ভেঙে নতুন পথ তৈরি করে। আর যারা নিজের ক্ষমতায় সমাজের গোঁড়া ধারণাকে ভেঙে দিয়ে সাফল্য অর্জন করেন, তারাই হয়ে ওঠেন বর্তমান সমাজের দুর্গা, ‘অন্য দুর্গা’।
আজকে আমরা আপনাদের এরকমই এক অন্য দুর্গার কথা জানাব, যিনি প্রতিদিন অদম্য লড়াই করে নিজের টিকে থাকার সংস্থান নিজেই করে আসছেন। ঝর্ণা মন্ডল—শহরের হাজারো গাড়ির চালকের মধ্যে এক অসাধারণ নারী। তাঁর জীবন আর পাঁচজন ড্রাইভারের মতোই মনে হতে পারে, কিন্তু তার ভিতরে লুকিয়ে আছে এক অদম্য সংগ্রামের কাহিনি। সকাল আটটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত গাড়ি চালান ঝর্ণাদেবী, শুধু রবিবারের ছুটিটা রেখে। রোববারটা তিনি পুরোপুরি পরিবারের জন্য রাখেন—বাড়ির ছোটখাটো কাজ, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানো, এইসব তোলা থাকে রবিবারের জন্য।
গাড়ি চালানোর শখ প্রথম থেকেই ছিল ঝর্ণাদেবীর। তবে, স্বামী ও সংসারের মাঝে শখ পূরণ আর হয়ে ওঠেনি। তবে, বছর সাতেক আগে যখন ঝর্ণাদেবীর স্বামী মারা যান, তখন যেন সবকিছু একেবারে বদলে যায়। সংসার চালানো, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, সবকিছুর দায়দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওপর। তাই কার্যত বাধ্য হয়েই কাজে নামতে হয়। তবে, প্রথমদিকে যেসব কাজ তিনি করেছিলেন, সেখানে খুব একটা টাকার মুখ দেখতে পেতেন না তিনি।
তখনই মাথায় আসে গাড়ি চালানো শেখার পরিকল্পনা। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। কোভিডের সময়, আজাদ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ঝর্ণাদেবী পেশাদার ড্রাইভার হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। সেই সময় গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে রাস্তা চেনার প্রশিক্ষণও নেন তিনি। প্রথমদিকে ঝর্ণাদিরও কিছু ভুল হত। যেমন, পার্ক স্ট্রিটের ওয়ান ওয়ে রাস্তায় ঢুকে পড়ে সমস্যায় জড়িয়ে পড়তেন প্রায়শই। তবে, সেই সময় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতেন কিছু ট্রাফিক সার্জেন্ট।
এহেন ঝর্ণাদেবীর সবচেয়ে বড় স্বপ্ন কি? তিনি চান, একদিন তারও নিজের গাড়ি হবে, মনের সুখে নিজের গাড়িতে করে ঘুরবেন পুরো পরিবার নিয়ে। এই ছোট স্বপ্নই তাঁকে এগিয়ে চলার শক্তি জোগায়। তিনি যেন এ শহরের প্রত্যেক সংগ্রামী নারীর প্রতিভূ। তথাকথিত পুরুষদের কাজে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে জীবনে একের পর এক সাফল্যের সিঁড়িতে চড়ছেন ঝর্ণাদেবী। তাই তিনি নিঃসন্দেহে আজকের যুগের এক ‘অন্য দুর্গা’।
Discussion about this post