চৈত্র সংক্রান্তিতে চরক পুজোর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে বাংলা বছরের। চরক উৎসব গ্রাম বাংলার একটি জনপ্রিয় লোক উৎসব। চরক উৎসবের একটি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রথা ‘গাজন’। গাজনের মাধ্যমে সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করেন। সাধারণত শিবের উপাসনার মাধ্যমে গাজন উৎসব পালন করা হয়। তবে পাতুন গ্রামে দেখা যায় তার বিপরীত ছবি। এখানে গাজন উৎসব মানে মা কালীর আরাধনা।
পূর্ব বর্ধমানের অন্তর্গত পাতুন গ্রাম। এখানেই দেখা যায় এই অদ্ভুত প্রথা। তবে এই প্রথার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হল, পূজিতা কালী কোনও মূর্তি নয়, মানুষই কালীর সাজে সেজে থাকেন। তাঁকে ঘিরেই চলে পূজা অর্চনা। প্রায় ৪০০ বছর ধরে চলে আসছে এই রীতি। এখানে নেই কোনও কালী মন্দির। তাই মা কালীর বেশে বহুরূপী গ্রামে ঘুরে ঘুরেই করেন গাজনের নাচ। নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করা হয়। মা কালীর এক হাতে থাকে খাঁড়া বা তরোয়াল এবং অন্য হাতে থাকে কাগজ বা মাটির তৈরি নরমুণ্ড।
বছরের পর বছর ধরে এই রীতি বজায় রেখেছেন পাতুন গ্রামের সাঁতরা পরিবার। সাঁতরা পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কেউ কালীর মুখোশ পড়ে কালী সাজতে পারেননা। এই মুখোশও রাখা থাকে ওই পরিবারের কাছেই। মুখোশকে নিত্য পুজো করা হয়। গ্রামের বাকি পরিবারের সদস্যরা সাজেন কালীর চ্যালাচামুণ্ডা আর শিব। মুখোশ পড়েই হয় নাচ গান সাধন ভজন। প্রায় ২০ বছর ধরে কালী সাজছেন সাঁতরা পরিবারের সিধু সাঁতরা। তিনি বলেন- “মুখোশ পড়ার পর কোনও একজন ব্যক্তিকে কালীর কোমড় ধরে রাখতে হয়। তাঁর কথায় কালী মানেই মহিমা তাই ঠাকুরকে ধরে রাখতে হয়, নাহলে প্রকৃত ঠাকুরটাই জলে চলে যাবে। এটাই বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে ভড় করেই বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে কালী সাধনা।”
যেহেতু কালীর উপাসনা তাই এই উৎসব হয় রাত জেগেই। এই বিশেষ উৎসব দেখতে ভিড় জমান পাতুন গ্রামের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দাউকাডাঙ্গা, ধেনুয়া, সাহাপুর, আসানপুরসহ পাশাপাশি গ্রামের বহু মানুষ। মা কালীর নাচে ঢাক-কাঁসি বা শিঙা-রামশিঙা সহ বিভিন্ন নরনের বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। লোকমতে আছে, নাচ আরম্ভ হওয়ার পর ধুনোর ধোঁয়া শুকিয়ে দিলে নৃত্যশিল্পীর উপর দেবী কালীর ‘ভর’ হয়। দেবীর ভরের বেগ যত বাড়তে থাকে নাচ তত উদ্দাম হয়ে ওঠে— শত্রুবধের নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে নৃত্যের সমাপ্তি ঘটে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ঢাকা, ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল ইত্যাদি অঞ্চলে এই নাচ প্রচলিত। বর্তমানেও বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় এই নাচের চল আছে। তবে বছর শেষের এই মজা উপভোগ করেন সবাই।
চিত্র ঋণ – debavasya
Discussion about this post