বাংলাদেশের ইফতারের কথা এলেই সবার প্রথম যে জায়গাটি মাথায় আসে সেটি হলো পুরান ঢাকা। অন্ততঃ একদিন এখানে ইফতার না করলে যেন রোজা অসম্পূর্ণ থাকে অনেকেরই। দুপুর থেকেই ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসে পড়েন দোকানিরা। প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার চকবাজারের ইফতার মার্কেট। এই চকবাজার পুরান ঢাকার বাদশাহী বাজার বলেও খ্যাত। মুঘল আমল থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নবাব ও তাদের খাস বাবুর্চি ও হালুয়াইরা এখানে আসতে থাকেন। আর তাদের সাথে আসে শাহী-নবাবী খানাপিনা। লোকে বলে এখানের খাবারে একটা শাহী আমেজ আছে। তার টানেই যেন সবাই ছুটে আসে এখানে ইফতার নিতে।
বর্তমানে এখানকার প্রধান আকর্ষণ, প্রায় ৭৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘বড় বাপের পোলায় খায়।’ আলু, ডিম, কিমা, কাবাব, বুট, চিড়েসহ মোট ৩১ টি উপাদান দিয়ে তৈরি হয় এই খাবার। অন্যান্য আকর্ষণ হলো মুর্গ মুসল্লম, মাছের কোপ্তা, আস্ত মুরগির রোস্ট, খাসি-গরুর লেগ রোস্ট, কোয়েল পখির রোস্ট, কবুতরের রোস্ট, চিকেন চাপ, চিকেন রোল, চিকেন ফ্রাই। জালি কাবাব, সুলতানি কাবাব, টিক্কা কাবাব, সুতি কাবাব, শামি কাবাব, হান্ডি কাবাব, তাস কাবাব, নার্গিস কাবাব, খিরি কাবাব, খাসির কাবাব যেন নবাবদের দস্তরখাঁনা সামনে ফুটিয়ে তোলে। এর সাথে থাকে ভিন্ন স্বাদের বাহারি সব পরোটা আর নান। খাসি-মুরগি-গরুর কিমা পরোটা, বিভিন্ন বাদাম দিয়ে তৈরি তাফতান নান, পুর ছাড়া পরোটা, বাকরখানি সবই পাওয়া যায়।
রেশমি শাহী জিলিপি একখানাই এক কিলোর। একসময়ের এই বনেদি মিষ্টির এখনো বিশাল নামডাক। ফিরনি, ক্ষীর, লাচ্ছা আর সেমাইও শাহী মিষ্টান্নের আস্বাদন করায়। মাটির পাত্রে রাখা ওই হালিম বা নিহারি কিনতে গেলে পার করতে হয় লম্বা লাইন। হরেক রকম ডাল আর মাংসের এই পদ পছন্দ নয় এমন মানুষ দুষ্কর। ইফতারের সাথে ভাজা পোড়া বা চপের সম্পর্ক অনন্য। ডিম চপ, শাহী ডিম চপ, খাসি-মুরগির চপ, গরু-খাসির টিকিয়া, চিংড়ির চপের সুগন্ধে চারিদিক মেতে থাকে। মুঘল খাজনার আরেকটি অন্যতম আকর্ষণ হলো শরবত। সারাদিন রোজা রেখে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত শরীরও সুস্থ রাখে। বিভিন্ন ধরনের ফলের জুস, বিভিন্ন ধরনের বাদামের শরবত, পেস্তা-কাজু-আমন্ড আর দুধ সহযোগে শরবত, বোরহানি, লাচ্ছি (লস্যি), তরমুজ-আমের লাচ্ছি, মাঠা, ঘোলের মতো হরেক পানীয় পাওয়া যায়। শরবতের ভেতর আরেকটি আকর্ষণীয় পানীয় হলো ‘লাবাং’। আরব থেকে আসা এই পানীয় টক দই, ঘি, মধু, পেস্তা বাদাম, দুধ দিয়ে বানানো হয়। এ ছাড়াও থাকে শরীর ঠাণ্ডাকারী ফালুদা এবং দই বড়া।
পুরান ঢাকার খাবার দাবারের সবসময়ের বড় অংশ হলো কাচ্চি বিরিয়ানি। কাঁচা মাংস দিয়ে তৈরি হয় বলে এর নাম কাচ্চি বিরিয়ানি। পুরান ঢাকার প্রতিটি দোকানের রয়েছে নিজস্ব বিশেষত্ব। অনেক দোকান ঘি বা মাখনের পরিবর্তে অনেকে শুধু সরিষার তেলে রান্না করেন বিরিয়ানি। আস্ত মুরগির কাচ্চি এবং আস্ত মুরগির মোরগ পোলাও শাহী ঐতিহ্য বহন করে। বংশ পরম্পরায় এসব খাবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। আর তাদের হাতের জাদু উপভোগ করতেই দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন খাদ্যপ্রেমীরা। শাহী মসজিদের পাশের এই রাস্তায় বিকেলের আজান ও নামাজের পর কেনাবেচা এতোই বেড়ে যায় যে রাস্তায় প্রায় প্রতিদিনই যানযট লাগে। রমজান মাস ছাড়াও এখানকার খাবারের স্বাদ সবসময়ই ক্রেতাদের আকর্ষণ করে। খাবারের টানে আসা মানুষের ভিড়ে প্রায়ই অবরুদ্ধ হয়ে যায় এই এলাকা।
চিত্র ঋণ – প্রতিদিনের বাংলাদেশ
Discussion about this post