আপনি কি জানেন আপনার বইয়ের গায়ে কী ধরনের গন্ধ লেগে রয়েছে? ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন’-এর গবেষকরা কিন্তু তা ভালো মতোই জানেন। হেরিটেজ সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত গন্ধ ও ইতিহাস বিষয়ক একটি পেপারে, গবেষকগণ গন্ধকে সংরক্ষিত করার ব্যাপারে কথা বলেন। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসে যে, হঠাৎ গন্ধকে সংরক্ষিত করার কথা বলা হল কেন? গবেষকদের মতে, আমাদের স্নায়ু তন্ত্রের এক বিশেষ গুণ রয়েছে। কিছু কিছু গন্ধ আমাদের বেশ আবেগপ্রবণ করে তুলতে পারে। বিশেষ করে যে গন্ধগুলির সাথে আমাদের কিছু স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। অতীতের সঙ্গে নিজেকে গভীরভাবে যুক্ত করার ক্ষমতাও বাড়াতে সাহায্য করে গন্ধ। আবার কিছু ক্ষেত্রে গন্ধ বাড়িয়ে তোলে আমাদের নস্টালজিয়া! তাই গন্ধের সঠিক চিহ্নিতকরণ, বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষণের প্রয়োজন। রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষকরা গন্ধ সংরক্ষণের এক সুন্দর উপায়ও বের করে ফেলেছেন।
লন্ডনের সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল এবং চ্যাপ্টার গ্রন্থাগারের দর্শকরা প্রায়ই বলাবলি করেন, সেখানে নাকি তাঁরা প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ পান। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে গ্রন্থাগারে আসা কিছু দর্শককে গবেষক প্রশ্ন করেন যে, সেই স্থান থেকে যে সুগন্ধী পাচ্ছেন সেগুলিকে তাঁরা চিহ্নিত করতে পারেন কিনা! প্রায় সমস্ত দর্শকই মনে করেন সেই গন্ধটি কিছুটা বনজ সুগন্ধীর মত। আবার কিছু দর্শক ধোঁয়ার মত গন্ধ পান। এছাড়াও কিছু মানুষ ভেজা মাটির বা ভ্যানিলার মত গন্ধও অনুভব করেন। বাকি কিছু দর্শক আবার বাসি বা কটু জাতীয় গন্ধ পাচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন। অন্য আর একটি গবেষণায়, বার্নিংহাম মিউজিয়াম এবং আর্ট গ্যালারিতে (ইউ কে) আগত ৭৯ জন দর্শকের মন্তব্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, গন্ধগুলির জন্য দায়ী একটি পুরনো বইয়ের দোকান। তখন বইয়ের গন্ধকে সংরক্ষিত করে রাখার জন্য একটি উপায় বের করেন তারা। একটি জীবাণুমুক্ত গজ কাপড়কে বইয়ের গন্ধ যুক্ত ৫ মিলি লিটারের একটি সুগন্ধীর মধ্যে ডোবানো হয়। তারপর সেটিকে একটি মুখবন্ধ ধাতু নির্মিত টিনের পাত্রের মধ্যে রাখা হয় যাতে দর্শকরা বাইরে থেকে উঁকি দিয়েও কিছু দেখতে না পান। এরপর যখন দর্শকদের প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তাঁরা ঠিক কিরকম গন্ধ পাচ্ছেন? তখন সব থেকে জনপ্রিয় তিনটি উত্তর ছিল- চকোলেট, কফি এবং পুরোনো কিছুর গন্ধ!
গবেষকের দলটি বই এবং গ্রন্থাগারের মধ্যে উপস্থিত উদ্বায়ী জৈব যৌগিক পদার্থ গুলিকে (ভোলাটাইল অরগাণিক কম্পাউন্ড) বিশ্লেষণ করেও দেখেছেন। জৈব যৌগিক পদার্থগুলি প্রায়ই বিভিন্ন গন্ধের সাথে যুক্ত থাকে। রাসায়নিক বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং দর্শকদের বিবরণ মতে, গবেষকরা ‘হিস্টোরিক বুক ওডার হুইল’ গঠন করেছেন। যাতে ‘হিস্টোরিক লাইব্রেরী স্মেল’গুলিকে সংরক্ষিত করে রাখা হয়। হুইল বা চক্রটির মুখ্য বিভাগ ‘মিষ্টি বা স্পাইসি’ থাকে ভিতরের গণ্ডীতে, ‘ক্যারামেল বা বিস্কুট’ থাকে মাঝখানে এবং রাসায়নিক পদার্থের গন্ধগুলি থাকে একদম বাইরের গন্ডিতে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বই থেকে প্রাপ্ত গন্ধগুলি শুধুমাত্র নস্টালজিক কারণেই পাওয়া যায় না। বিভিন্ন রাসায়নিক এবং গবেষণামূলক তথ্যও জড়িয়ে আছে সেখানে। যতই বই আমাদের কল্পনা বা ফ্যান্টাসির কোনও দুনিয়ায় নিয়ে চলে যাক, বইয়ের গন্ধ কিন্তু আমাদের বাস্তবিক বিজ্ঞানের গবেষণার কথা মনে করাতে বাধ্য।
Discussion about this post