“আপনাদের কাছে অনুরোধ রাখছি ড্যাম তৈরী হওয়ার পর নিজেরদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে। যদি চলে যান, তবে তাতে আপনাদেরই ভালো, নয়তো আমরা (ড্যাম থেকে) জল ছেড়ে সবাইকে ডুবিয়ে মারবো।” – কী, কোনো বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমার মারকাটারি ভিলেন কাম রাজনীতিবিদের সংলাপ মনে হচ্ছে? আজ্ঞে না। কোনো সিনেমা নয়, এটা সত্যিই বাস্তবেই এক মহান রাজনীতিবিদের বক্তব্য। ১৯৬১ সালে হিমাচল প্রদেশে পং ড্যাম নিয়ে মোরারজি দেশাই এক জনসভায় এই মন্তব্য করেছিলেন। অবশ্য এটিকে একপ্রকার হুমকিও বলা যেতে পারে। নামটা শুনে চমকে উঠলেন বুঝি ? হ্যাঁ, ইনি সেই মোরারজি দেশাই, যিনি আবার একসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। অবশ্য এই মন্তব্য করার সময় তিনি ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। হিমাচল প্রদেশের পং ড্যাম তৈরী হওয়ার সময় তিনি ড্যামের পার্শ্ববর্তী এলাকার দীর্ঘদিনের বসবাসকারী আদিবাসীদের একপ্রকার ‘হুমকি’ দিয়েছিলেন ঠিক সিনেমার ভিলেনদের মতোই।
প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রসঙ্গ যখন চলেই এলো, তখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কথাই বা বাদ যায় কি করে! ১৯৪৮ সালে হীরাকুঁদ বাঁধের কারণে উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি এক অসাধারণ মন্তব্য করেন। “যদি আপনাদের ভোগান্তি হয়ে থাকে, তবে তা দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই হয়ে থাকে।” যথারীতি এই বাঁধ নির্মাণের ফলে যে আবার বহু সংখ্যক আদিবাসীদের বাস্তুচ্যুত হতে হয়ে ছিল, সেকথা বলাই বাহুল্য। পরবর্তীকালে দেশের উন্নয়ন কতটা হয়েছে তা পরের বিষয়, সেই বাস্তুচ্যুত আদিবাসীরা কিন্তু বঞ্চনার শিকার হয়ে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছেন ধীরে ধীরে।
ফিরে আসি সাম্প্রতিক অতীতে। নর্মদা ড্যামের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে নিয়ে সমাজসেবী মেধা পাটকার, অভিনেতা আমির খান এবং গুজরাট সরকারের মধ্যে বিরোধের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। যেই গুজরাট সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির নরেন্দ্র মোদী, যিনি বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও বটে। তবে এই সংঘাত আসলে চলছিল বহু আগে থেকেই। বেশ কয়েক দশক ধরে, যার একদিকে ছিল ভারত সরকার এবং অন্যদিকে মেধা পাটকার সহ অন্যান্য পরিবেশবিদ, সমাজকর্মী, কৃষিজীবী মানুষজন, আদিবাসী সম্প্রদায়, মানবাধিকার কর্মী প্রমুখরা। চাপে পড়ে নিরপেক্ষ তদন্তে দেখা গিয়েছিল যে এই ড্যাম তৈরী করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় পরিবেশবিধি মানা হয়নি মোটেই। স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে তাদের দাবি বা মতামত নিয়ে ঠিকঠাক আলোচনা করা হয়নি। ড্যাম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও অনুমতিপত্র খুঁটিয়ে দেখা হয়নি। এমনকি উচ্ছেদ হওয়া স্থানীয় আদিবাসীদের সামান্য যা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল তা মোটেও পুনর্বাসনের জন্য যথাযথ ছিল না। যার ফলে এটির নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদানকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক একসময় সরে দাঁড়ায়। তবুও বারবার অত্যাচার ও আক্রমণের শিকার হওয়া দীর্ঘ কয়েক দশকের আন্দোলন ব্যর্থ করে ২০০৬ সালে এটির নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়। তবে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের দাবিতে এখনো লড়াই জারি হয়েছে।
স্বাধীনতার পর ভারতে এই ড্যাম বা জলাধারগুলি তৈরীর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পানীয় জলের পর্যাপ্ত যোগান। কৃষিতে অগ্রগতি, সেচব্যবস্থার উন্নতিসাধন, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানোে মতো জনকল্যাণমূলক কাজ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এইসব প্রকল্পের ফলে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আদিবাসীরা এবং অবশ্যই পরিবেশ। বেশির ভাগ ড্যাম তৈরির শুরুর সময় যত সংখ্যক মানুষের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে তার বহুগুণ বেশী মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই বহু দশক পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখনও জমির ন্যায্য মূল্য বা পুনর্বাসনের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাননি। এছাড়াও উন্নয়নের বলি হওয়া বনজঙ্গল, পশুপাখী, বাস্তুতন্ত্র কোনোদিনই ফিরে আসেনি আর। দেশের সার্বিক বিকাশ তখনই হবে, যখন কোনো উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে দেশের প্রতিটি মানুষ। পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে উন্নয়ন যে আসলে ক্ষণিকের মরীচিকা, তা সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগই প্রমাণ করছে।
Discussion about this post