তিনশো বছরের শহর কলকাতা। সুতরাং এর গহ্বরে রয়েছে নানান সাদা-কালো গল্প। যা আধুনিক কলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে আজও রঙিন মনে হয়। আধুনিক কলকাতার জনক জব চার্ণক ও ওয়ারেন হেস্টিংস হলেও এই কলকাতারও একটা উত্তর রয়েছে। যার উত্তর আজও বহন করে চলেছে বাঙালিয়ানা ও তার ঐতিহ্য।
প্রসূন বন্দোপাধ্যায়ের মতে, “উত্তর কলকাতা কোনও বিশেষ স্থান নয়, একটা অন্তর্লীন জীবন।” সেই অন্তর্লীন জীবনে কত কী যে রয়েছে তা বলা বাহুল্য। এই যেমন ব্যোমকেশ বক্সীর বাড়ি। চিনাপট্টির মেস বাড়ি থেকে অজিত উঠে এসেছিল ব্যোমকেশের হ্যারিসন রোডের বাড়িতে। শরদিন্দু সেই বাড়িতে বসেই ব্যোমকেশের হাত ধরে সমাধান করে গেছেন একের পর এক রহস্য। আর এই বিষয়গুলো বাঙালির রক্তে এমন ভাবে মিশে গেছে যে আজও হ্যারিসন রোডের ওপর হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় এখানের কোনও এক বাড়ির দোতলায় সত্যবতী ও অজিতের সঙ্গে থাকত ব্যোমকেশ বক্সী।
উত্তর কলকাতার হ্যারিসন রোডে ঠিক কোন বাড়িটায় থাকতেন ব্যোমকেশ বক্সী, এই প্রশ্নের উত্তরে আজও যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত বর্তমানের এম জি রোড। ৬৬ নং এর পরেই উচ্চারিত হয় ‘হ্যারিসন রোড’। যেখানে ভেঙে পড়া সাইন বোর্ডের ওপর লেখা আছে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস, স্থাপিত ১৯১৭। শোনা যায় তিনশো বছরের শহরের এই ইতিহাসে ব্যোমকেশের এই বাড়ির ইতিহাস একশো বছরের। শুধু শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, একসময় জীবনানন্দ দাশেরও ঠিকানা ছিল এই হ্যারিসন রোড। যদিও এই হ্যারিসন রোডের গল্প ব্যোমকেশের থেকেও পুরনো। কবিগুরুর লেখায় পাওয়া যায়, “হাওড়ার ব্রিজ চলে মস্ত সে বিছে, হ্যারিসন রোড চলে তার পিছে পিছে।” আর এর পিছনেই রয়েছে এই রাস্তার ১৮৯২ সালের ইতিহাস। এই হ্যারিসন রোডের নাম তৎকালীন আই.সি.এস স্যার হেনরি লেল্যান্ড হ্যারিসনের নাম অনুসারে রাখা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৫৬ সালে, এই রাস্তার নাম হয় মহাত্মা গান্ধী রোড। তবে এই রাস্তার তৈরির পিছনে আসল ভূমিকা অধিগ্রহণ দপ্তরের প্রথম বাঙালি ডেপুটি কালেক্টর কালীচরণ ঘোষের।
সাহিত্যের পাতা থেকে বেড়িয়েও হ্যারিসন রোডের একটা আলাদাই ছবি চোখে ধরা দেয়। শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহের যে ইতিহাস সেখানেও সবার আগে ধরা দেয় হ্যারিসন রোডের নাম। সালটা ১৮৯৯, তখন সিইএসসি-এর নাম ছিল ইন্ডিয়ান ইলেক্ট্রিক কোম্পানি লিমিটেড। সেই সময় ব্রিটিশ সরকার কলকাতার মোট ৫৬৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বিদ্যুৎ পরিষেবার জন্য ২১ বছরের সময় দিয়েছিল কোম্পানিকে। সেই বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল হ্যারিসন রোড। নোনা ধরা দেওয়াল, ভেঙে পড়া বাড়ির চাঙর দেখতে দেখতে চোখে পড়ে দু’ধারে সারি সারি দোকান। সেই অর্থে এই হ্যারিসন রোডকে লক্ষ্মীর আবাসস্থান বললেও অযৌক্তিক হবে না। জামা-কাপড়, মশলা-পাতি থেকে শুরু করে, ছাতা, নেমন্তন্নের কার্ড, খেলাধুলার সামগ্রী সবকিছুর দোকানই দেখা যাবে। কলকাতার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বড়বাজারও এই রাস্তার ওপর। শুধু তাই নয়, এখানের ফল বাজারও বেশ জনপ্রিয়, যা প্রধানত ফলপট্টি নামে পরিচিত। আর একটু এগিয়ে গেলেই বইপাড়া- কলেজ স্ট্রিটের মোড়। সেখানে থেকেই একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে ক্যালকাটা ব্যান্ড, মেহবুব ব্যান্ডের মত একাধিক মিউজিক্যাল ব্যান্ড। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, স্বাধীনতার আগে অর্থাৎ ১৯৪৫-এর আশে পাশে এই ক্রসিংয়ে কলকাতার যে চিত্র দেখা যেত তা আজও অপরিবর্তিত। ব্যস্ত জনজীবন আর বড় বড় বিজ্ঞাপনের হোডিং-এ ঢাকা বিল্ডিং। যানবাহনের চরিত্র পাল্টালেও সমগ্র চিত্রের কোথাও হেরফের হয়নি।
কলকাতার এইসব রাস্তাগুলোরই নিজস্ব গল্প আছে। এমন কত অজানা ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই রাস্তার সাথে। উপরন্তু কলকাতার প্রতিটা গলিতে রয়েছে স্মৃতি, সব কিছুতেই নস্টালজিয়ার আঁচড়। আর এই সব কিছু থেকেই জন্ম নিয়েছে এই শহরের রোম্যান্টিসিজম।
প্রতিবেদনে মেঘা মণ্ডল
Discussion about this post