ভারত সবে স্বাধীন হয়েছে। ওদিকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছে দুটো আলাদা ভূখণ্ড। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্কান। পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু ভাষা প্রধান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মূল ভাষা বাংলা। ক্ষমতাসীন পাকিস্তান সরকার দুই ভূখণ্ডেই উর্দু চাপিয়ে দিতে চাইল। তার প্রতিবাদ এবং বাংলা ভাষার অধিকারের লড়াই শুরু হল পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত অসংখ্য মানুষ পুলিশ গুলিতে মারা গেলেন। দিনটি তাই পরিচিত ভাষা শহিদ দিবস নামেও। তবে, এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকলের মৃত্যু ঘটেনি ঠিকই, তবে অনেকের জীবনে নেমে এসেছিল অদ্ভুত আঁধার। তারই নিদর্শন হলেন মমতাজ বেগম।
পেশায় শিক্ষিকা মমতাজের বিয়ের আগের নাম ছিল কল্যাণী রায়। ১৯২৩ সালে হাওড়ায় তাঁর জন্ম। বাবা রায়বাহাদুর মহিমচন্দ্র রায় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি এবং মা মাখনমতিদেবী ছিলেন শিক্ষিকা। সম্পর্কে মমতাজ প্রমথনাথ বিশীর ভাগনি। ম্যাট্রিক পাশের পরে রক্ষণশীল পরিবারের অনিচ্ছায় তিনি বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাশ করে চাকরি করতেন স্টেট ব্যাঙ্কে। সেখানেই তাঁর আলাপ হয় অফিসার আব্দুল মান্নাফের সঙ্গে। বাড়ির অমতে তিনি বিয়েও সারেন। ধর্ম পরিবর্তনের পর কল্যাণীর নাম হয় মমতাজ বেগম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএড পাশ করে নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হলেন। এমনই চলতে চলতে ‘৫২ সালে ঘটল বিপত্তি।
এই সময়েই শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষা আন্দোলন। ক্রমশ নারায়ণগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে উঠলেন মমতাজ। নিজের স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে মিছিল করতে গিয়ে ২৯ ফেব্রুয়ারি তিনি গ্রেফতার হলেন। এই খবর ছড়িয়ে যেতেই ক্ষেপে উঠল মানুষ। পুলিশের হাতে আহত হল বিক্ষুব্ধ জনতা। মমতাজের উপরেও চলেছিল নির্যাতন। এদিকে সরকারি কর্মকর্তা স্বামীকে বলা হল তাঁর স্ত্রী ভাষা আন্দোলন ছেড়ে দেবেন, এই মর্মে চুক্তি সই করলে তবেই তাঁকে ছাড়া হবে। নাহলে তিনি স্ত্রী কে তালাক দেবেন। ওদিকে মমতাজ বললেন তিনি কোনোভাবেই এই আন্দোলন থেকে সরবেন না। অতএব, তালাক!
বাংলা ভাষার এই আন্দোলন মমতাজ, তথা কল্যাণীর কাছে হয়ে উঠেছিল প্রাণের সমান। কলকাতায় নিজের পরিবার তাঁকে ত্যাগ করেছিল ধর্মের কারণে, অন্য এক দেশে টালমাতাল পরিস্থিতিতে তাঁকে ত্যাগ করল তাঁর স্বামী। অথচ এসবের পরেও ভাষার অধিকারের আন্দোলন তিনি ছাড়েন নি। দেড় বছর পর যখন তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, তাঁর চাকরি ছিল না, পরিবার ছিল না। শেষ জীবন তিনি কাটিয়েছিলেন ঢাকার আনন্দময়ী স্কুলে শিক্ষিকার পদে যোগ দিয়ে। এছাড়াও, তাঁর জীবনের চালিকা শক্তি ছিল শিশুশিক্ষার বিস্তার এবং বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় অধিকারের দাবিতে আন্দোলন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৬৭ সালের ৩০ জুন।
Discussion about this post