আজকের এই স্বাধীন ভারতের পেছনে রয়েছে কয়েক শত রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস। রক্ত ঝরেছে বহু বীরের আত্মবলিদানে। কিন্তু বর্তমান সময়ের মত সেদিনও তারা বঞ্চিত হয়েছিল তৎকালীন রাজনীতিবিদদের কাছে। পরাধীন ভারতের শোষিতদের এক আন্দোলনে তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের বিশ্বাসঘাতকতার এক অজানা কাহিনী ‘মুলুক চলো’ আন্দোলন। যাকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের এক ‘কালো অধ্যায়’ বললে কোনও ভুল বলা হবে না।
সময়টা উনিশ শতকের প্রথম দিক। তৎকালীন অসম এবং সিলেটের চা বাগানগুলির মালিক ছিল ইংরেজ সাহেবরা। মধ্যভারত, দক্ষিণের মাদ্রাজ থেকে বিপুল অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে দালালদের মাধ্যমে সেখানকার গরিব মানুষদের এই চা বাগানে নিয়ে আসা হত। এর জন্য দালালরা এক অদ্ভুত গল্প ছড়াতো, যে সুদুর পূর্বে এমন এক জায়গা আছে যেখানে গাছের পাতায় পাতায় সোনা ফলে থাকে। গরীব মানুষেরা একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার লোভে ওই দালালদের খপ্পরে গিয়ে পড়ত।
রপর শ্রমিকদের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এক অদ্ভুত চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করত চা বাগান মালিকরা। শ্রমিকরা যেহেতু ‘এগ্রিমেন্ট’ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারত না, ফলে সেই চুক্তিপত্রকে তারা বলত ‘গিরমেন্ট’। শ্রমিকদের কোনও বেতন দেওয়া হত না। তার বদলে পাতের তৈরি পাতলা টি-টোকেন দেওয়া হত। এর সাহায্যে একমাত্র চা-বাগানের ভেতর থাকা দোকান থেকেই তারা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করতে পারত। এই ভাবে চা শ্রমিকদের আর্থিকভাবে এমন পরিস্থিতিতে রাখা হত যে তারা যেন চা-বাগানের বাইরে পা রাখার সাহস না পায়। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের বেতন ব্যবস্থা চালু হলেও, তা ছিল যথেষ্ট কম। তাদের মাসিক বেতন হিসেবে মাত্র তিন পয়সা করে দেওয়া হত। এই সময়ে গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে, শ্রমিকরা সিদ্ধান্ত নেয় এই আন্দোলনে অংশ নেবে। তারা চা-বাগান ত্যাগ করে নিজেদের ভিটেতে ফিরে যাবে। তাদের এই আন্দোলনই ছিল ‘মুলুক চলো’ আন্দোলন।
এই সময় চা বাগানের মালিকরা রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আটকে দেয়। বন্দরে পুলিশ মোতায়েন করে শ্রমিকদের বাড়ি ফিরে যাওয়াতে নানা উপায়ে বাধা দানের চেষ্টা করে। দিনটি ছিল ১৯২১ সালের ২০ মে। এদিন সারা বিশ্ব দেখেছিল ব্রিটিশদের নিষ্ঠুরতার এক চরম নিদর্শন। ওই দিন চাঁদপুর রেল স্টেশনে বহু শ্রমিক রাত কাটাচ্ছিলেন সকালে ট্রেন ধরে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেওয়ার জন্য। কিন্তু চাঁদপুরের মহকুমা শাসক সুশীল কুমার সিংহের নেতৃত্বে গোর্খা সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায় তিন হাজার শিশু, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধের ওপর। রেল স্টেশনেই বেয়োনেটের খোঁচায় এবং গুলি চালিয়ে হত্যালীলা চলে। অনেক শিশুকে পার্শ্ববর্তী মেঘনা নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলা হয়!
তবে এরকম নৃশংস গণহত্যার পরেও এই আন্দোলনকে সমর্থন না জানিয়ে, তীব্র বিরোধিতা করেন মহাত্মা গান্ধী! তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন- “অসহযোগ আন্দোলন পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে ছিল না, তা ছিল কেবলমাত্র ইংরেজদের বিরুদ্ধে!” ফলে আন্দোলনের তীব্রতা কমতে শুরু করেছিল। সেই সময় তাদের সমর্থন জানান রেল শ্রমিক আন্দোলনের নেতা দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। তার নেতৃত্বে টানা আড়াই মাস রেল ধর্মঘট চলে বাংলা ও অসম জুড়ে। এই ঘটনায় প্রায় ৫ হাজার শ্রমিককে বরখাস্ত করে ইংরেজ সরকার। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক লজ্জাজনক অধ্যায় রূপে ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে এই আন্দোলন। এই আন্দোলন যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় দেশের রাজনৈতিক নগ্নতা।
তথ্য ঋণ – ভিন্নসময়
Discussion about this post