ঠাকুরবাড়িতে প্রায়শই বসত খামখেয়ালি সভা। সেই সভায় কবি থাকতেন মধ্যমণি। সেই খামখেয়ালিপনা থেকেই হয়তো তিনি রাত দুটোর সময় মৃণালিনী দেবীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কিছু রান্না করে খাওয়াতে বলতেন। শোনা যায় এই ঘটনা প্রায়ই ঘটত। মাঝরাতে মৃণালিনী দেবী রান্না করে রবীন্দ্রনাথকে খাওয়াতেন। কবি দেশি খাবারের মধ্যে পছন্দ করতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি। এ ছাড়া তিনি কাবাব খেতে খুব পছন্দ করতেন। কাবাবের তালিকায় ছিল শ্রুতি মিঠা কাবাব, হিন্দুস্তানি তুর্কি কাবাব ও চিকেন কাবাব নোসি। কলকাতার ঠাকুরবাড়িতে এখনো সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে মৃণালিনী দেবীর রান্নাঘর। সেখানে রয়েছে তার ব্যবহৃত একটি চুলা, আর বেশ কিছু চিনামাটির বাসন। কবি কাঁচা আম খেতে ভালোবাসতেন, আচারও খেতেন। কাদম্বরী দেবী কবিকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁচা আম এনে দিতেন। এখানেই শেষ নয়, কবিগুরু ছিলেন পানের ভক্ত। তার নাতজামাই কৃষ্ণ কৃপালিনী তাঁকে একটি সুদৃশ্য পানদানি বা ডাবর উপহার দিয়েছিলেন, যা আজও রয়েছে ঠকুরবাড়িতে। ঠাকুরবাড়ির রান্নায় বেশি করে মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন ছিল। গরম মশলা, লবঙ্গ, দারুচিনি বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হতো। রান্নার তালিকায় প্রতি দিনই দীর্ঘ পদ থাকত। আর তাতে নিয়মিত অবশ্যই থাকত সুক্তো আর দই মাছ। রবীন্দ্রনাথ দেশে-বিদেশে যেখানেই যেতেন সেখানে গিয়ে নতুন নতুন খাবার খেতে ভালোবাসতেন।
কোনো খাবার পছন্দ হলেই কবিগুরু জেনে নিতেন কী করে বানানো হয়েছে? তাঁর স্ত্রীর কাছে পরে সেই সব খাবার খেতে চাইতেন। তা ছাড়া ছোট থেকেই ঘটা করে পালিত হতো তাঁর জন্মদিন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদা নন্দিনী রবি ঠাকুরের জন্মদিন প্রথম পালন করেন। সে অনুষ্ঠানে ইংরেজি কায়দায় কেক কাটাও হতো। রবীন্দ্রনাথের ভোজনপ্রীতি বাড়ির ঠাকুরঘরকেও প্রভাবিত করেছিল। দেশ-বিদেশ ঘুরে তিনি বিভিন্ন ভোজের নিমন্ত্রণের সাক্ষী থেকেছেন। প্রসিদ্ধ রেস্তোরাঁর মেনু কার্ড সংগ্রহ করে সেগুলো নিয়ে এসে ঠাকুরবাড়ির রসুইঘরের ঠাকুরদের দিয়ে দেশি এবং বিদেশি রান্নার ফিউশন করিয়েছেন। যা থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন স্বাদের খাবার। এরই মধ্যে সেগুলো নিয়ে রন্ধনশিল্পীরা বেশকিছু বইও প্রকাশ করেছেন।
ব্রিটিশ শেফ শন কেনওয়ার্দি কবিগুরুর সংগৃহীত মেনু কার্ডগুলো ফের সংগ্রহ করেন এবং তাঁর ভালোলাগা রেসিপিগুলোর ওপর গবেষণা করেন। পরবর্তী সময়ে একই উপকরণ ও মশলা ব্যবহার করে সে সব খাবার তাঁর নিজের ক্যাফেতে এমনভাবে পরিবেশন করেন, যেন তার স্বাদ ও সুবাস অপরিবর্তিত থাকে। মাত্র ১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার তার বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। প্রতিটি দেশের ভালো লাগা খাবারগুলো সময়-সুযোগ বুঝে ঠাকুরবাড়ির হেঁসেলে চালু করে দিতেন কবি। যেমন ইউরোপের কন্টিনেন্টাল ডিশের একটি ফ্রুট স্যালাড ঠাকুরবাড়িতে চালু করেন তিনি।
একটা সময় ছিল যখন ঠাকুরবাড়িতে সবাইকে নিয়ে কবিগুরু একসঙ্গে খেতে বসতেন। কবি জাপানি চা পছন্দ করতেন কেবল তা-ই নয়, সঙ্গে তাদের চা খাওয়ার রেওয়াজটিও ছিল তাঁর পছন্দের। তাই তিনি জাপানে গেলে প্রায় প্রতিদিনই তার জন্য ‘টি সেরিমনি’র আয়োজন করতেন গুণমুগ্ধরা। খাবারের তালিকায় থাকত গ্রিন ভেজিটেবল স্যুপ, ক্রিম অব টমেটো স্যুপ, স্যামন ইন হল্যান্ডেন সস এ্যান্ড কিউকামবার, প্রি-সল্টেড উইথ গ্রিন ভেজিটেবল, রোস্ট চিকেন, ফেঞ্চ ফ্রাই, গ্রিন স্যালাড ও আইসক্রিম।
Discussion about this post